বাংলায় দুটো প্রাচীন প্রবাদ আছে, “ঠেলার নাম বাবাজি” ও “ঠেলায় পড়লে বিড়ালও গাছে ওঠে”। বর্তমান মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের হয়েছে ওই একই অবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা মহাপরিচালক বা ডিরেক্টর অফ ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স তুলসী গ্যাবার্ড ভারত সফরে এসেছিলেন। তাঁর ভারতে আসার কারণ ছিল মূলত একটি আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সম্মেলনে যোগ দেওয়া, যার আয়োজন করেছিল ভারত। বিশ্বের ২০টি দেশের গোয়েন্দা প্রধান এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যোগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম মুখ তুলসী গ্যাবার্ড। যদিও ওই সম্মেলন ছাড়াও তুলসী দ্বিপাক্ষিক কয়েকটি বৈঠকে অংশ নেন। যেমন আলাদা করে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। প্রথমটি বাদে বাকি দুটি সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হলেও দিল্লির বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে প্রতিটি বৈঠকই হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আলোচনার জন্য। অর্থাৎ তুলসী গ্যাবার্ডের সব বৈঠকগুলিই পূর্ব নির্ধারিত এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে হয়েছে। তুলসী বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, আর গোল বেঁধেছে তাতেই। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কয়েকটি মন্তব্য করেন। যা নিয়ে শোরগোল শুরু হয় বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের তরফ থেকে বিবৃতি দিয়ে দাবি করা হয়, তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য বিভ্রান্তিকর ও বাংলাদেশের পক্ষে অবমাননাকর।
সোমবার সন্ধ্যায় সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভি মার্কিন গোয়েন্দা মহাপরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের সাক্ষাৎকার লাইভ সম্প্রচার করে। সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ‘ইসলামি খেলাফত’ নিয়ে। এই প্রশ্নের উত্তরে তুলসী বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুব লম্বা সময় ধরে সেখানে হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, ক্যাথলিক ও অন্যদের ওপর যে ধর্মীয় নির্যাতন, হত্যা ও অত্যাচার চালানো হচ্ছে সেটা আমেরিকার সরকার তথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের জন্য খুব বড় একটা উদ্বেগের জায়গা”। আশ্চর্যজনকভাবে সোমবার সন্ধ্যায় করা তুলসীর মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্যগুলি অত্যন্ত ‘বিভ্রান্তিকর’ এবং ‘বাংলাদেশের সুনাম ও ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর’। একইসাথে অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে, “গ্যাবার্ডের মন্তব্য সুনির্দিষ্ট কোনেও প্রমাণ বা অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি” বরং “পুরো জাতিকে মোটা দাগে ও অযৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে”। এখানেই শেষ নয়, অন্তর্বর্তী সরকার ওই বিবৃতিতে দাবি আরও করেছে, বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং সন্ত্রাসবাদীদের দমন করেছে। মজার বিষয় হল, বিবৃতির এই শেষের অংশটি শেখ হাসিনা সরকারের গুণগান হিসেবেই দেখছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।
কেন এ কথা উঠছে, ইউনূস সরকার কিভাবে হাসিনা সরকারের গুণগান করলো, এই প্রসঙ্গে তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন আকাট্য। ওয়াকিবহাল মহলের একটা অংশ দাবি করছেন, তুলসী গ্যাবার্ডের বিরুদ্ধে বিবৃতি জারি করে বিপদ ডেকে আনলেন বাংলাদেশের। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান কোনও তথ্য-প্রমান ছাড়া বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন কথা বলেছেন। কিন্তু ইউনূস সরকারের আমলে বাংলাদেশে যে একের পর এক শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া বা জেলভাঙা আসামীদের ধরার চেষ্টা না করা নিয়ে বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া খবর করে আসছে। পাশাপাশি ঢাকা-সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তেহরীর প্রকাশ্য মিছিল, খিলাফতের পতাকা ওড়ানো, প্রকাশ্যে মিডিয়ায় বক্তব্য দেওয়া নিয়েও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম খবর করেছে। আবার গত ৭ মার্চ ঢাকা শহরে রীতিমতো ঘোষণা করে পোস্টার সাঁটিয়ে মার্চ ফর খিলাফত শিরোনামে একটি বিশাল মিছিল করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হিসেব অনুযায়ী ওই মিছিলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার হিজবুত সদস্য জড়ো হয়েছিল। যা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব সহকারে খবর প্রকাশ করেছিল। আবার ইউনূস সরকারের আমলে যখন সংখ্যালঘু হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের খাঁড়া নেমে আসছিল, তখনও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম খবর করেছে। কিন্তু ইউনূস সরকার সে সময় কিছুই বলেনি বা প্রতিক্রিয়া জানায়নি, শুধু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দোষারোপ করা ছাড়া। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্তা তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হল এবার। যা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে চুপ থাকবে না এটা বলাই বাহুল্য। সূত্রের খবর, জামায়তে ইসলামের প্রবল চাপেই নাকি মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস উইং গভীর রাতে এই ধরণের বিবৃতি জারি করতে বাধ্য হয়েছে। যাই হোক না কেন, এটা বুমেরাং হয়ে ফিরবে তা নিঃসন্দেহ। এবার আসা যাক হাসিনা প্রসঙ্গে।
মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিগত সাতমাসের কর্মকাণ্ডে আমরা বরাবরই দেখেছি বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা এবং আওয়ামী লীগ কর্মী-নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, মোকদ্দমা-সহ নানা ধরণের ব্যবস্থা নিতে। আবার তৌহিদি জনতার নামে একদল উশৃঙ্খল মানুষ গোটা বাংলাদেশেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে গিয়েছে। আওয়ামী নেতা-কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা খুন হয়েছেন, ধর্ষিতা হয়েছেন। পুলিশ-সেনা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে চুপ ছিল। ইউনূস সরকারের সাতমাসের শাসনামলে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যেই তাঁরা ঘুরে বেরাচ্ছে। আবার মহিলাদের পোশাকবিধি, চালচলনের বিধিনিষেধ দেওয়া হচ্ছে প্রকাশ্যেই মাইক ফুঁকে। রোজার সময় কোনও হোটেলে যদি কেউ খেতে ঢোকেন, তাঁকে প্রকাশ্যেই মারধোর করা হচ্ছে। আর এই সমস্ত ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালও হচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসন নিশ্চুপ। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড এটা বলতেই তাঁকে মিথ্যাবাদী প্রমানে উঠেপড়ে লাগলো মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাঁর মন্তব্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বাংলাদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র-সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা এবং সন্ত্রাসবাদ দমন নিয়ে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে ভিত্তিহীনভাবে ইসলামি খিলাফতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ দাবি করছে, বাংলাদেশ ইসলামি চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যে লড়াই করেছে তা মূলত শেখ হাসিনার আমলেই হয়েছে। তিনিই একের পর এক সন্ত্রাসী জঙ্গি নেতাদের জেলে পুরেছেন। বহু সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছেন, তাঁদের কাজকর্মে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বিগত সাত মাসে এর কিছুই করেনি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, বিবৃতিতে যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তা বিগত হাসিনা সরকারের সাফল্য। এতএব, ঠেলায় পড়ে শেখ হাসিনার গুণগান করতেও পিছপা হলেন না সুবিধাবাদী ইউনূস।
Discussion about this post