বাংলাদেশে এ বছর ঈদুল ফিতর পালিত হচ্ছে এক নতুন রাজনৈতিক আঙিনায়। এবারের ঈদে যেমন বিএনপি, জামায়তে ইসলামীর মতো পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মতো করে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগে ব্যস্ত, অন্যদিকে সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিও নিজেদের পায়ের তলার জমি শক্ত করতে ঈদের সময়কেই বেছে নিয়েছে। আবার অন্যদিকে এবার ঈদের উৎসবে নেই বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। গত বছর ৫ আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রায় ৯৫ শতাংশ নেতা দেশ ছাড়া বা আত্মগোপনে রয়েছেন। আর বাকি ৫ শতাংশ জেলের ঘানি টানছেন। স্থানীয় ছোট নেতারা বা কর্মীরা আজও নিজ এলাকা থেকে বহু দূরে লুকিয়ে বেরাচ্ছেন। আবার গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় যত এগিয়েছে, ততই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মতভেদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি বিগত রমজান মাসে ইফতার পার্টিগুলিতে দেখা গিয়েছে একই স্থানে দাঁড়িয়ে একেক রাজনৈতিক পার্টির নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাখছেন। অথবা আলাদা আলাদা ইফতারের আয়োজন করছেন। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের বুকে এ যেন এক অন্য ঈদ। প্রশ্ন হল, কেন এমন হল? গণ অভ্যুত্থানে দেশের সাধারণ মানুষ যেখানে তথাকথিত “স্বৈরাচারি শাসক“ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পতন চেয়েছিল। এবং তাই হয়েছে। সেখানে এত মতভেদ থাকবে কেন? এমনকি এই প্রশ্নও উঠছে, মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে এবার প্রকৃতই কি দেশবাসী সুরক্ষিত থেকে খুশির ঈদ পালন করতে পারছেন?
বিগত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল দেশে জাতীয় নির্বাচনের দিন-তারিখ কবে ঘোষণা হবে। তাই রোজার মধ্যে নানাভাবে নিজেদের উপস্থিতি জারি রাখার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। উল্লেখযোগ্য দিক হল, জামায়াতে ইসলামী এবং সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি জোর দিয়ে এসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্কার এবং জুলাই অগাস্টে নিপীড়নের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারে দাবিতে। অর্থাৎ, অগ্রাধিকারের দিক থেকে এগুলোর পরে নির্বাচনকে রেখেছে তাঁরা। অপরদিকে বিএনপি-সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল চাইছে, আগে নির্বাচন, পরে সংস্কার। অর্থাৎ, বিএনপির দাবি, বাংলাদেশে যা যা সংস্কারের প্রয়োজন, তা নির্বাচিত এক সরকারই করবে। গণতন্ত্রের দিক থেকে এটাই বাস্তব চাওয়া। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকেও বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের তদারকি সরকার অস্বীকারও করতে পারছে না। যেমন সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে”।
বিএনপি যে এই বক্তব্যে খুব একটা খুশি নয় সেটা তাঁরা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পরই তাঁরা হতাসা প্রকাশ করেছিল। এবার পবিত্র ঈদের দিনে বিএনপি নেতা তথা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা পালন করবে, এমনটাই প্রত্যাশা করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, এবারের ঈদ মুক্ত ও আনন্দময় পরিবেশে আমরা ঈদ পালন করছি।
গত ডিসেম্বর থেকেই বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ‘ধোঁয়াশা’ ও ‘অস্পষ্টতার’ অভিযোগ তুলে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। এবার এ দাবিতে তারা আরও সক্রিয় হতে চায়। আরও একবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাগাদা দিতে চাইছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে ‘অস্পষ্টতা’কে বিএনপি দেখছে সন্দেহ ও সংশয় নিয়ে। আসলে নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করার পেছনে কারণ কী, সেটি বুঝতে চায় তাঁরা। অন্যদিকে, মুহাম্মদ ইউনূসের অনুগামী হিসেবে পরিচিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা দ্রুত নির্বাচনের থেকে সংস্কারকে আগে জোর দিচ্ছেন। এর পিছনে তাঁদের উদ্দেশ্য হল, সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দলের মাটি শক্ত করা। জামাতকে পাশে নিয়ে যাতে তাঁরা বিএনপিকে নির্বাচনে টেক্কা দিতে পারে। আর এই কাজটা যে খুবই কঠিন সেটাও বুঝে গিয়েছে ছাত্রনেতারা। যেমন সারজিস আলম, যিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের অন্যতম সংগঠক। তিনি সম্প্রতি এক ফেসবুক স্টেটাসে লিখেছেন প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের মত একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সারজিস আলম ইঙ্গিত দিলেন মুহাম্মদ ইউনূসকে সামনে রেখেই তাঁরা নির্বাচনে ঝাঁপাতে চান। কারণ, তাঁর জনপ্রিয়তা এখনও বাংলাদেশে রয়েছে। তাঁকে সেনাপতি করেই জাতীয় নাগরিক পার্টি নির্বাচনের যুদ্ধ জয় করতে চায়।
এবার আসা যাক আওয়ামী লীগের কথায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথমবার ঈদের উৎসবে দেখা গেল না আওয়ামী নেতাদের। শেখ হাসিনা এথন ভারতের আশ্রয়ে, তাঁর দলের অধিকাংশ নেতাই হয় ভারত না হয় অন্য কোনও দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু হাসিনা হাল ছাড়েননি। তিনি এবারও ঈদে জাতির উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে হাসিনাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লিগ তাঁর বক্তব্য প্রচার করেছে। তাতে শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর মতোই হাসিনার শুভেচ্ছা বার্তাকে তাঁর দল দেশবাসীর উদ্দেশে বাণী বলে উল্লেখ করেছে। এটাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লিগের বক্তব্য, শেখ হাসিনাকে জোর করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় বিরাট এক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে। সেটা বুঝতে পেরেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। নিয়ম হল রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে তাঁর সামনে পদত্যাগপত্রে সই করতে হবে। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটেনি। ফলে হাসিনাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বেশ কয়েকবার তাঁর বক্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন হবে ইনক্লুশিভ বা অন্তর্ভূক্তিমূলক। ফলে নির্বাচন যবেই হোক, আওয়ামী লীগ অংশগ্রহন করবেই। সেটা রিফাইন্ড হোক বা হাসিনার আওয়ামী লীগ হোক।
Discussion about this post