বাতাসে বারুদের গন্ধ, চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। এমনিতেই দুই প্রতিবেশী দেশ কয়েক মাস আগেও ছিল একে অপরের পরিপূরক, আজ তাঁদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কার্যত সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধের মুখে। ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে এই মুহূর্তে একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আজ পবিত্র ঈদ, বাংলাদেশ জুড়ে খুশির আবহাওয়া থাকলেও কোথাও যেন একটা তাল কাটছে। যে বাংলাদেশ কিছুকাল আগেও যুদ্ধের জিগির তুলতো কথায় কথায়, আজ ভারতের দিক থেকেই যেন সেই কথা উঠছে। যদিও প্রকাশ্যে এরকম দাবি করা যাবে না, তবে ভিতরে ভিতরে একটা প্রস্তুতি চলছে বিগত কয়েকদিন ধরেই। কেন এ কথা বলছি? সেটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
ভারত যে বাংলাদেশের প্রতি বিরক্ত সেটা বেশ কয়েকটি কারণে বোঝা যাচ্ছিলো। পাশাপাশি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের অবস্থানও স্পষ্ট। কোনও অবস্থাতেই ভারত মুহাম্মদ ইউনূসের এই তদারকি সরকারের হাতে শেখ হাসিনাকে তুলে দেবে না। কারণ এই সরকারকে ভারত মান্যতাই দিচ্ছে না। সেই কারণে কিছু পূর্ব নির্ধারিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেও বাকি সব কূটনৈতিক চ্যানেল বন্ধ করে রেখেছে। বিশেষ করে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসতে চেয়ে একাধিকবার ঢাকা থেকে প্রস্তাব এলেও নয়া দিল্লি কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। উল্লেখ্য থাইল্যান্ডে আসন্ন বিমস্টেক সম্মেলনের ফাঁকেও যে দুই রাষ্ট্র প্রধানের বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। হাসিনার প্রত্যাবর্তন চেয়ে বাংলাদেশ একাধিক চিঠি দিলেও ভারত তার একটারও জবাব দেয়নি। ফলে পরিষ্কার ভারত কোনও ভাবেই এই তদারকি সরকার বা অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাইছে না। এর কারণ হিসেবে কূটনৈতিক মহলের একাংশ দাবি করছেন, ইউনূস সরকারের প্রথম কয়েক মাসের কার্যকলাপ পুরোটাই ভারত বিদ্বেষী ছিল। কথায় কথায় ভারত বিরোধী মন্তব্য করে গিয়েছেন বাংলাদেশের কয়েকজন উপদেষ্টা। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা যখন ভারতকে কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ করতে গিয়ে রীতিমতো হুমকি দিয়েছেন, তখনও তদারকি সরকার তার বিরোধিতা করেনি বা তাঁদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করেনি। বরং তাঁরা পাকিস্তানকে বেশি করে আপন করে নিয়ে ভারতকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে। ভারত যখন বারবার বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হওয়া অত্যাচার বন্ধ করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, ইসকনের সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর জামিন নিয়ে কথা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার তখন ভারতকে জবাব দিয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলাতে। এই ব্যাপারগুলো ভারত ভালোভাবে নেয়নি এটা বলাই বাহুল্য। এবার মুহাম্মদ ইউনূস চিন সফর করলেন। সেখানে তিনি তিস্তা নদী প্রকল্প, মোংলা বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প চিনের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা পাকা করে এসেছেন। অন্যদিকে, এমন খবরও সামনে এসেছে পাকিস্তানে বালুচ বিদ্রোহীদের হাত থেকে তাঁদের সম্পত্তি সুরক্ষিত করতে বেসরকারি সেনাবাহিনী মোতায়েন করছে চিন। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তানে চিন-পাক ইকোনমিক করিডরে কর্মরত চিনা ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই নিরাপত্তাকর্মীদের মোতায়েন করতে শুরু করেছে চিন। যদিও পাকিস্তান তা অস্বীকার করেছে। মুহাম্মদ ইউনূসের পাকিস্তানের সঙ্গে মাখামাখি, চিনের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্টতা ভারতকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। ফলে কূটনৈতিক স্তরে বৃদ্ধি পাচ্ছে তৎপরতা।
সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় বর্মা ঢাকা থেকে দিল্লি উড়ে গিয়েছিলেন। জরুরিভিত্তিতেই তাঁকে তলব করা হয়েছিল নয়া দিল্লিতে। সূত্রের খবর, তিনি বৈঠক করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অতিজ ডোভাল এবং ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর সঙ্গে। এরমধ্যে শেষের জনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটি নজিরবিহীন। যা সচরাচর হয় না বললেই চলে। জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত প্রণয় বর্মাকে তলব করা হয়েছিল। বিশেষ করে এই মুহূর্তে জেহাদি সংগঠনগুলির কর্মকাণ্ড, তাঁদের লোকবল ও মতবল বুঝতে যেমন তথ্য চাওয়া হয়েছিল, তেমনই তদারকি সরকারের মধ্যে জামায়তে ইসলামী, হিজবুত তেহরীর প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে। কিন্তু এই আলচনায় সেনাপ্রধান কেন, সেটা সম্পর্কেই রহস্য দানা বাঁধছে। তবে কি ভারত বড় ধরণের কোনও সেনা অভিযানের পরিকল্পনা করছে? আমরা জানি, বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশ লাগোয়া চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোরে একাধিক সামরিক মহড়া দিয়েছে ভারত। এখনও আকাশপথে ভারতীয় বিমানবাহিনী টানা মহড়া দিয়ে চলেছে। ভারত সরকার, সবদিক প্রস্তুত রাখছে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যৌথ সংসদীয় কমিটি, পররাষ্ট্র সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সঙ্গেও একপ্রস্থ আলোচনা হয়ে গিয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে। এরপরই তলব করা হয় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতকে। ফলে কৌতুহল তো একটা থাকছেই। তবে ঈদ মেটার অপেক্ষা?
Discussion about this post