বাংলাদেশের পূর্ব প্রান্তের দেশ মিয়ানমার। যেখানে এখন চলছে তীব্র গৃহযুদ্ধ। একদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অন্যদিকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এমন মোট ৮টি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এখন মিয়ানমারের জুন্টাবাহিনীর সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি হল আরাকান আর্মি। যাদের মূল লড়াই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ নিয়ে। আর এই রাখাইন প্রদেশটি একেবারে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। জানা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই রাখাইন প্রদেশের সম্পূর্ণ দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি, ফলে বাংলাদেশ সীমান্তের ২৭১ কিমি এখন তাঁদের দখলে চলে এসেছে। যা নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশ। প্রথম সঙ্কট, আরাকান আর্মির মতো এক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মোকাবিলা করা আর দ্বিতীয় সঙ্কট হল রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা আচমকা বেড়ে যাওয়া। যা বাংলাদেশের তদারকি সরকারের মোকাবিলা করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে নেই বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ দখলের তীব্র লড়াই শুরু হয় প্রায় ২ মাস আগে। যদিও বিগত ১১ মাস ধরে আরাকান আর্মি বিচ্ছিন্নভাবে এই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গত দুই-আড়াই মাসে তাঁরা মিয়ানমারের জুন্টাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েছে। আর এই সময়কালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূস যেমন করেছেন, গত কয়েক মাসে অন্তত ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে। সম্প্রতি মিশরের কায়রো সফরে গিয়ে এক বৈঠকে তিনি এই দাবি করেন। আবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন দাবি করে বসেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গত দুই মাসে বাংলাদেশে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার দাবিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু দুজনের দাবিতে একটা বিষয়ে মিল রয়েছে, সেটা হল সময়কাল। দুজনেই গত দুই মাসে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বলেছেন। অর্থাৎ অনুপ্রবেশের সময়সীমা এক।
বাংলাদেশের তদারকি সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গির আলম স্বীকার করে নিয়েছেন, মিয়ানমারের মংডু শহর আরকান আর্মির দখলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমার দিকের ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত আরকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এর ফলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে। তিনি এও দাবি করেন, যেহেতু আরাকান আর্মি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, তাই তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো এই মুহুর্তে কঠিন কাজ। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত, চিন ও লাওসের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক পরামর্শ সভায় যোগ দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। সেখানে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলি তাঁদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। পরে ঢাকায় ফিরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, মিয়ানমারকে বলেছি সীমান্ত আপনাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সেই নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। আমরা তো একটা রাষ্ট্র হিসেবে নন-স্টেট অ্যাক্টর যারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তাদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারি না। কাজেই আপনাদের দেখতে হবে কোন পদ্ধতিতে সীমান্ত এবং রাখাইনের সমস্যার সমাধান করবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন আপাতত আরাকান আর্মি নিয়ে বাংলাদেশের তদারকি সরকার কতটা অসহায়।
যদিও তৌহিদ হোসেন স্বীকার করে নেন, ওই আলোচনা সভায় কয়েকটি রাষ্ট্র নিজেদের এলাকায় সীমান্ত, মাদক, অস্ত্র, মানব পাচার নিয়ে জোরদার সাওয়াল করেছেন। তিনি বলেন, সীমান্তের ব্যাপারে প্রধানত, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্ত নিয়ে বেশি কথা হয়েছে। স্ক্যাম সেন্টার কতগুলো গড়ে উঠেছে, যেটায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হয়; সেই অপরাধ নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া মাদক তো আছেই। অপরাধ এবং বর্ডার ইস্যুতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়। তবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ে যে ওই বৈঠকে খুব একটা আলোচনা হয়নি সেটাও স্বীকার করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, পশ্চিমের সীমান্ত, যেখানে আমাদের স্বার্থ আছে। সেটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। আসলে সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই দিশেহারা হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের তদারকি সরকার। একদিকে হাজারে হাজারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছে। সেই দলে ভিরে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে মিয়ানমারের সশস্ত্র রোহিঙ্গা জঙ্গিরাও। আর তাঁদের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে আরাকান আর্মি। পাশাপাশি আরাকান আর্মি ঘোষণাই করে দিয়েছে, তাঁরা রাখাইন প্রদেশকে খুব শীঘ্রই স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবে। এরমধ্যে বাংলাদেশেরও কিছু ভূখণ্ড ঢুকে যেতে পারে সেটাও অসম্ভব নয়। ফলে সবদিক দিয়েই চাপে বাংলাদেশ।
Discussion about this post