বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ‘মব’ ও ‘মব জাস্টিস’ শব্দ দুটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। এখনও পর্যন্ত মব জাস্টিস নিয়ে গোটা বাংলাদেশ উত্তাল। কখনও মব জাস্টিসের নামে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আক্রমণ, গণধোলাই, তাঁদের বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট করাকেই মব জাস্টিসের নাম দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি শব্দ ‘মব’-এর অর্থ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’। আর সেই ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ যখন নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায় তখন তাকে ‘মব জাস্টিস’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার’ বলা যায়। আসলে এ প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পান না। উচ্ছৃঙ্খল জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। মব জাস্টিসের মাধ্যমে কোনও ন্যায়বিচার হয় না। কারণ, এখানে সাক্ষী, বিচারক ও শাস্তিদাতা—সবকিছুর ভূমিকায় থাকে এই উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে এটা কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি পরিকল্পিত কিছু।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিগত দশ মাস ধরে গোটা দেশেই মব জাস্টিসের নামে এক নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষই মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তার আগে থেকেই গোটা বাংলাদেশজুড়ে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। পরে যা গণঅভ্যুত্থানের রূপ দেওয়া হয়। হাসিনা সরকারের পতন এবং তাঁর ভারতে পালিয়ে আসার পর বাংলাদেশে এক বিশেষ শ্রেণির মানুষ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চিহ্নিত করে আক্রমণ করা শুরু করে। তাতে বহু আওয়ামী নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়। বহু নারীর সম্মান যায়। বহু মানুষ ঘারবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। যত দিন যেতে থাকে, ততই এই আক্রমণ বা মব জাস্টিসের তীব্রতা বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগ ছাড়াও এর শিকার হতে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধারা এবং তাঁদের পরিবার, হাসিনা আমলের আমলা, সরকারি কর্মী এবং অবশ্যই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার এবং তাঁর প্রশাসন চুপ করে দেখছিলেন। কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের “মব জাস্টিস” এক মুখরোচক খবর হিসেবে উঠে আসে। প্রবলভাবে সমালোচিত হতে শুরু করেন শান্তির নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। ফলে একটু নড়েচড়ে বসে সরকার। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তখন তাঁদের হাতের বাইরে। এবার আসরে নামে সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান নির্দেশ দেন, মব জাস্টিস কঠোরভাবে দমন করতে হবে। সেনাবাহিনীও ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মব জাস্টিসের নেপথ্যে যারা, তাঁরা তো সরকারেই অন্যতম অঙ্গ। অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-সমন্বয়করা এবং কোনও ক্ষেত্রে জামাত এবং বিএনপির স্থানীয় নেতারাই মব তৈরি করে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছিলেন। ফলে সেনাবাহিনীও প্রবল বাঁধার মুখে পড়ছিল।
কিন্তু যখন ‘মব’ সৃষ্টি করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকেই জুতোর মালা পড়িয়ে একদল ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ চরম অপমানিত করলেন, তাঁকে মারধোর করলেন। তখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও সেটা নিয়ে সমালোচনা শুরু করল। কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশের এক আদালতেও একই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল। এক আসামীকে ছিনিয়ে নিয়ে মব জাস্টিসের নামে মারধোর করা হয়েছিল। সবমিলিয়ে সরকারের মুখ পুড়ছিল ক্রমাগত। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও আতঙ্কিত এই মব কালচার নিয়ে। রাতের বেলা ঢাকার মতো শহরে কেউ বাস বা ট্রেন ধরতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ ঘরের বাইরে দোকানপাট করতে যেতেও ভয় পাচ্ছেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার দাবি করেছিলেন, যে বা যারা মব জাস্টিসের সঙ্গে জড়িত থাকবেন তাঁদের কঠোর সাজা হবে। এমনকি পুলিশও যদি মব নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাঁরাও শাস্তির মুখে পড়বেন। কিন্তু আদতে দেখা গেল তা চোখে ধুলো দেওয়ার মতো ঘটনা। কারণ, কে এম নূরুল হুদাকে হেনস্তার ঘটনায় করা মামলায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁদের জামিন হয়ে গেল। প্রসঙ্গত, উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব মো. হানিফ-সহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল মব সৃষ্টি এবং প্রাক্তন নির্বাচনী আঘিকারিককে হেনস্থার ঘটনায়। মজার ব্যাপার হল, ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার সময় সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া এ ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, নূরুল হুদাকে জুতা দিয়ে মারছিলেন মুজাম্মেল হোসেন ঢালী নামে এক অভিযুক্ত। তাঁরও জামিন হয়ে গেল। ফলে মব জাস্টিস চলছে, চলবে।
Discussion about this post