আন্দামান সাগরে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ, যা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একেবারে কাছে অবস্থিত। এই দ্বীপটির ভৌগলিক অবস্থান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই দ্বীপ যার দখলে থাকবে, তাঁদের হাতে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্বের চাবিকাঠি থাকবে। আদতে একটি দ্বীপ নয়. কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জের একত্রে নাম কোকো দ্বীপ। যা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মাত্র ৫৫ কিমি দূরে অবস্থিত। আদতে এই দ্বীপ মিয়ানমারের দখলে। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকেও এই কোকো দ্বীপ নিয়ে কম রহস্য ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যু সামনে আসতেই নতুন করে কোকো দ্বীপ নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। কেন কোকো দ্বীপ এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ভারতের নিরাপত্তার দিক থেকে? দাবি উঠছে, ভারত যেন জাতীয় নিরাপত্তার কারণে এই কোকো দ্বীপের দখল নেয়। এখন প্রশ্ন উঠছে, কেনই বা বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশ এই কোকো দ্বীপের উপর তাঁদের নজরদারি স্যাটেলাইট স্থির করে রেখেছে? এই দ্বীপের ইতিহাসই বা কি, অথবা ভারতের সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কি, কেনই বা ভারত এই দ্বীপ দখল নিতে চাইছে? এই বিষয়েই আজকের প্রতিবেদন।
ইতিহাস বলছে, একসময় কোকো দ্বীপপুঞ্জ উত্তর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অংশ ছিল, যা মিয়ানমারকে উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। ঠিক যেমনটা বর্তমান চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। আন্দামানের বিজেপি সাংসদ বিষ্ণুপদ রায় লোকসভার ভোট পর্বে এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেছিলেন, “কংগ্রেস সর্বদাই ভারত বিরোধী মনোভাব পোষণ করেছে। নেহেরু কোকো দ্বীপপুঞ্জ, যা উত্তর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অংশ ছিল, মিয়ানমারকে উপহার দিয়েছিলেন, যেটি বর্তমানে চীনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে বাহ্যিক নিরাপত্তা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে”। বিজেপি সাংসদ খুব একটা ভুল কথা বলেননি। কোকো দ্বীপপুঞ্জ কৌশলগত কারণে এখন গোটা বিশ্বেরই মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠছে।
প্রথমেই একটু বলে রাখি এই কোকো দ্বীপপুজ্ঞের ইতিহাস। সেই আঠারো শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুজ্ঞের সঙ্গেই কোকো দ্বীপের দখল নিয়েছিল। উনিশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ সরকার এই দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করে। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার এই দ্বীপে একটি পেনাল কলোনী বা দ্বীপান্তর সাজা প্রাপ্তদের জন্য আবাসস্থল তৈরি করেছিল। ১৯৩৭ সালে ভারত থেকে তৎকালীন বার্মা বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় আশ্চর্যজনকভাবে কোকো আইল্যান্ড বার্মার হাতে দেওয়া হয় এবং আন্দামান ও নিকোবারকে ভারতের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ-সহ কোকো দ্বীপগুলির দখলও নেয়। পরে ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর কোকো দ্বীপপুঞ্জ ফের বার্মার দখলে যায়। সেই সময় অনেকেই ভারতের কাছে আর্জি করেছিল কোকো আইল্যান্ডের দখল নেওয়ার জন্য। কিন্তু জওহরলাল নেহেরু তা করেননি। এটাই এখন ভারতের মাথাব্যাথার কারণ। ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজ বিবিসিকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৫০ সালে বার্মাকে কোকো দ্বীপপুঞ্জ ‘দান’ করেছিলেন এবং এইভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদ সমর্পণ করেছিলেন।
১৯৬২ সালে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, এই দ্বীপগুলিতে সেনাবাহিনী নতুন করে একটি পেনাল কলোনি প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তীতে মিয়ানমার নৌবাহিনী সেখানে একটি নৌ ঘাঁটিও গড়ে তোলে। তবে ১৯৯৪ সালে, চীন এই কোকো দ্বীপগুলি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে এই লিজ নিয়েছিল। যদিও উভয় দেশই এ ধরনের কোনও চুক্তির বিষয়ে অস্বীকার করে। সেই সময় থেকেই গোটা বিশ্বের নজর ঘুরে যায় এই কোকো দ্বীপগুলির দিকে। ব্রিটিশ পলিসি ইনস্টিটিউট চ্যাথাম হাউসের এবং ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তোলা কয়েকটি স্যাটেলাইট ছবিতে কোকো দ্বীপে আধুনিক সামরিক পরিকাঠামো নির্মাণের চিত্র ধরা পড়েছে। সেখানে ২,৩০০ মিটার রানওয়ে তৈরি হয়ে গিয়েছে। একটি রাডার স্টেশন, দুটি নতুন হ্যাঙ্গার এবং একটি আবাসন ব্লক এবং জলরাশিকে বিভক্ত করা পথের সন্ধান মিলেছে। প্রতিটি নির্মানই যে চিন করছে, সেটা বলাই বাহুল্য। এখন প্রশ্ন হল, এই কোকো দ্বীপ কি ভারত ফেরত নিতে পারবে? আর ফেরত আনতে গেলে কোন উপায়ে তা সম্ভব?
১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কোকো দ্বীপ আকৃতিতে ছোট হলেও এর অবস্থান কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল মালাক্কা প্রণালীর কাছাকাছি নয়, ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে মাত্র ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আন্দামানে ভারতীয় নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর ঘাঁটিও রয়েছে। আবার কোকো দ্বীপপুঞ্জ আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যপথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ফলে চিন এখানে সামরিক ঘাঁটি নির্মান করে ফেললে তাঁদের দখলে থাকবে এই এলাকা। যেটা এখন ভারত ও আমেরিকার মাথাব্যাথার কারণ। ভারত যেহেতু উপহার হিসেবে তাঁদের ব্যবহারের জন্য মিয়ানমারকে কোকো আইল্যান্ড দিয়েছিল। সেহেতু ভারতের অধিকার রয়েছে কোকো আইল্যান্ড ফেরত পাওয়ার। কোনও নির্বাচিত সরকার নয়, বরং মিয়ানমারের সেনা শাসক চিনকে কোকো দ্বীপপুঞ্জকে লিজ দিয়েছিল। ফলে মিয়ানমারের ক্ষমতায় যদি জননেত্রী আন-সান-সু-কি ফিরে আসতে পারেন তাহলে ভারতের সুবিধা হবে। না হলে ভারতকে সামরিক বল প্রয়োগ করতে হবে। যা অবশ্য এই মুহূর্তে ঝুঁকির। কারণ, এতে চিনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতে হবে ভারতকে। আর এই কোকো দ্বীপপুঞ্জ যদি ভারত পুনর্দখল করতে পারে, তাহলে চিন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ চরম বেকায়দায় পড়বে। ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলিতে মূলত মণিপুর ও মিজোরামে হিংসাত্মক কার্যকলাপ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
Discussion about this post