বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। তিনি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় এবং তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির মাত্র কয়েকমাস আগেই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু তথাকথিক গণঅভ্যুত্থান এবং তাঁর অব্যবহিত পর বাংলাদেশের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে জেনারেল ওয়াকার বড় মুখে বলেছিলেন তিনি বাংলাদেশের মানুষের জান-মালের দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ১৫ মাস পরও তিনি তা পালন করেছেন এমন দাবি তাঁর অন্ধ সমর্থকও হয়তো করতে পারবেন না। হাসিনার পতনের পর তাঁর ক্ষমতা না নেওয়া, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা এবং নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় জেনারেল ওয়াকার কার্যত হিরো হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা কার্যত আকাশ ছুঁয়েছিল। অনেকেই তাঁর উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন যে বাংলাদেশের একাটা ভালো কিছু হবে। কিন্তু তারপরই তিনি শীতঘুমে চলে যান। ফলে ধীরে ধীরে হিরো থেকে ভিলেনে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় লাগেনি জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের।
পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও সেনা অভ্যুত্থানের বহু নজির রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সেনাপ্রধান সেই সুযোগ পেয়েও দূরে থাকলেন। ফলে তাঁর একটা স্বচ্ছ ইমেজ তৈরি হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশ্যে বড় মুখে বলেছিলেন, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, একটা অন্তর্বর্তী সরকার আমরা গঠন করবো। এরপর সব বিচার হবে। সেই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জান-মালের দায়িত্ব নেওয়ার দাবিও করেছিলেন।
সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য শোনার পর বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে আস্থা জন্মেছিল যে এবার সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানেই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে। সেই সঙ্গে দ্রুত একটি কার্যকরী নির্বাচন হবে বাংলাদেশে। কিন্তু আদতে কি হল, বিগত দেড় বছরে সেনাপ্রধানকেই কার্য়ত ব্যাস্ত থাকতে হল নিজের পদ বাঁচাতে। বাংলাদেশ সেনার মধ্যে অখণ্ডতা রক্ষা করতে এবং কোনও প্রকারে আরেকটি ক্যু ঠেকাতে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারে নাক গলানোর মতো পরিস্থিতি তৈরিই হল না। অপরদিকে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হল বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার পাশাপাশি ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট দেখভাল করতে। কিন্তু তাতে কি বাহিনী সফল হয়েছে? গত ১৫ মাসে বাংলাদেশে অরাজকতা কি একফোঁটা কমেছে? বাংলাদেশের মানুষের জান-মাল কি রক্ষা করতে পেরেছে বাংলাদেশ সেনা? যাদের দায়িত্ব বৈদশিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাঁরা দেশের শত্রুর বিরুদ্ধেই ডাহা ফেল। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যে পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল, যেমন ওসমান হাদির উপর গুলি এবং তাঁর মৃত্যুর পর অরাজকতা। সেখানে বাংলাদেশ সেনার ভূমিকা ঠিক কি ছিল, কেনই বা সেনাবাহিনীকে খুঁজে পাওয়া গেল না, সেই প্রশ্ন এবার উঠতে শুরু করেছে।
হাদির মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই অশান্ত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। ঢাকায় দুটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর করে আগুনও ধরিয়ে দেয় জনতা। কিন্তু আমরা কি দেখলাম, সেনাবাহিনী অনেক পরে সেখানে পৌঁছয় এবং জনতার কাছে হাতজোর করে ২০ মিনিট সময় চায় আগুনে আটকে পড়া সাংবাদিক, সংবাদকর্মীদের উদ্ধার করার জন্য। অন্যদিকে, ময়মনসিংহে এক হিন্দু যুবককে গণপিটুনি দিয়ে তাঁকে গাছে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দিল মব। এই কাণ্ডকারখানা প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চললেও সেখানে পৌঁছতে পারেনি সেনাবাহিনী। খুলনা ও রাজশাহীতে ভারতীয় উপ হাইকমিশনে হামলা চালায় একদল দুষ্কৃতি। ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, উত্তেজিত জনতা ভারতীয় উপ হাইকমিশনের সামনে আগুন ধরিয়ে ইট-পাথর ছুঁড়ছে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সেনাসদস্যরা। অনেক পরে তাঁরা অ্যাকশন নেয়। অর্থাৎ, সেনাবাহিনী যেন কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে, ঘটনাবলী তাই প্রকাশ করে। এখানেই উঠছে প্রশ্ন, কেন বাংলাদেশ সেনা অশান্তি ঠেকানোর চেষ্টা করলো না?
এরমধ্যেই সর্বভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে জেনারেল ওয়াকার সরাসরি ফোন করেছিলেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীকে। একবার নয়, দুই বার তাঁদের ফোনে কথা হয়। তিনি নাকি ভারতে তাঁর কাউন্টার পার্টকে কথা দিয়েছেন বাংলাদেশে ভারতের সম্পদের কোনও ক্ষতি হতে দেবেন না। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের থেকে এবার দুরত্ব তৈরি করছেন। আবার কেউ কেউ দাবি করছেন, আওয়ামী লীগকে যেহেতু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছে না, সেহেতু নির্বাচন বানচাল করতে মাঠে নেমেছেন সেনাপ্রধান। আসলে জেনারেল ওয়াকার যে কোন পক্ষে, সেটা বোঝার ক্ষমতা কারও নেই। আসলে তিনি গভীর জলের মাছ।












Discussion about this post