ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পরিসেবা জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ইন্টারনেট ট্রানজিট দেওয়ার যে চুক্তি হয়েছিল, তা বাতিল করেছে মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার। এখন প্রশ্ন হল, এই চুক্তি বাতিল হওয়ায় ভারতের কতটা ক্ষতি হল আর বাংলাদেশের কতটা লাভ হল?
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং মৌ সাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর সে দেশে ক্ষমতায় আসে তদারকি সরকার। যার নেতৃত্বে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। তাৎপর্যপূর্ণভাবে শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে একটা ভারতবিরোধী হাওয়া সৃষ্টি হয়েছে। এবং তার প্রভাবে ভারতের সঙ্গে হওয়া চুক্তিগুলি পূনর্মূল্যায়ণ করবে বলে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশের তদারকি সরকার। এরমধ্যে অন্যতম হল বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইন্টারনেট ট্রানজিট সুবিধা। গত মাসে বাংলাদেশ টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি জানিয়ে দেয়, এই প্রস্তাব রদ করা হল। তাঁদের যুক্তি ছিল, ভারতকে দেওয়া এই ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশের পক্ষে ক্ষতিকর। তবে পরবর্তী সময় বোঝা গিয়েছে, ভারতকে এই ইন্টারনেট ট্রানজিট সুবিধা না দেওয়ার পিছনে রয়েছে অন্য উদ্দেশ্য। এখানে যতটা না ভারতবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তার থেকে বেশি কাজ করেছে আওয়ামী লিগের প্রতি ক্ষোভ।
জানা যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর থেকে সমুদ্রের তলা দিয়ে কেবলের মাধ্যমে আসা ইন্টারনেট সংযোগ বাংলাদেশের কেবল ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে পাঠানো হবে। এই হল ইন্টারনেট ব্যান্ডইউথ ট্রানজিট সুবিধা। এই চুক্তি ২০২৩ সালে হয়েছিল। সামিট কমিউনিকেশন এবং ফাইবার অ্যাট হোম বাংলাদেশের দুই সংস্থা ভারতের ভারতী এয়ারটেলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই সংযোগ প্রদান করার কথা ছিল। বাংলাদেশের ওই দুই সংস্থা কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যান্ডইউথ পৌঁছে দেবে এবং এরপর ভারতের এয়ারটেল তা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে দেবে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন এই তিন সংস্থাকে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে ইন্টারনেট ব্যান্ডইউথ সরবরাহ করার অনুমোদনও দিয়েছিল। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান হলেন মুহাম্মদ ফরিদ খান, যিনি আওয়ামী লিগের শীর্ষ নেতা ফারুক খানের ভাই। আবার ফাইবার অ্যাট হোম সংস্থার মালিকও শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘণিষ্ঠ। ভারতের সঙ্গে এই চুক্তির ফলে এই দুই সংস্থা সবচেয়ে বেশি লাভবান হতো। ফলে মূলত শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লিগের নেতাদের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই বাংলাদেশের তদারকি সরকার এই চুক্তি বাতিলের ঝুঁকি নিচ্ছে।
অপরদিকে, এই চুক্তি যদি সত্যিই বাতিল হয় তাহলে ভারতের কতটা ক্ষতি হবে, পাশাপাশি বাংলাদেশের কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে সেটা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষন। ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যান্ডইউথ সংযোগ ভারতকে না দেয়, তাহলে ভারতের খুব একটা ক্ষতি হবে না। কারণ, ভারতের নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যান্ডইউথ আছে। এই মুহূর্তে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে ইন্টারনেটের যা চাহিদা তাতে খুব প্রভাব পড়ার কথা নয়। কিন্তু মোদি সরকার উত্তরৃপূর্ব রাজ্যগুলিতে একাধিক তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পতালুক এবং হাব তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। যা আগামীদিনে ইন্টারনেটের চাহিদা ও গতি বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু ইতিমধ্যেই ভারত পশ্চিমবঙ্গের দিঘায় একটি কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। যা আগামী বছরের শেষ দিকে পুরোপুরি কার্যকর হয়ে যাবে। ফলে এখান থেকেই আগামীদিনে উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ দ্বিতীয় বিকল্প ছিল। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ট্রানজিটের প্রথম চুক্তিটি এখনও কার্যকর আছে ২০২১ সাল থেকে। আর এই দ্বিতীয় চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশ বিপুল পরিমান শুল্ক হারাল। এবং আগামীদিনে দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্টারনেট হাব হয়ে ওঠার একটা সুযোগও হারাল।
Discussion about this post