হারাম খাইয়া আমি এমন মোটা হয় নাই, যে স্পেশাল কফিন লাগবে। খুব সাধারণ একটি কফিনে হালাল রক্তের হাসিমুখে আমি আল্লাহর কাছে হাজির হতে চাই। এমনটাই বলেছিলেন শরীফ ওসমান হাদি। তাঁর মৃত্যুর আগে এমন ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন। তাঁর শেষ তিনটি ইচ্ছের মধ্যে দুটি পূরণ হওয়ার পথে। তৃতীয় ইচ্ছেটা রাষ্ট্র কতটা পূরণ করতে পারে, সেটা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। দেশ মায়ের কাছে করা হাদির শেষ তিনটি ইচ্ছে পূরণের দিকে নজর প্রত্যেকের।
মৃত্যুর আগে যে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন হাদি, সেটাই পূরণ হতে চলেছে। শুক্রবার বিকেলে সিঙ্গাপুর থেকে দেশের পথে রওনা হওয়া কফিনটি সন্ধ্যায় বাংলাদেশে পৌঁছয়। কথা ছিল, জীবনের শেষ বিমানে চড়ে তিনি ফিরবেন বিজয়ের বেশে। কিন্তু ফিরল ওসমান হাদির নিথর দেহ। কফিন বন্দী হয়ে নিজের দেশে ফিরল হাদির দেহ। কাকতালীয়ভাবে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে বেশ কয়েকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন হাদি। যেখানে তিনি এমন কিছু পোষ্ট দিয়েছিলেন, যেখানে বোঝা যায়, হয়তো হাদি বুঝতে পেরেছেন তাঁর জীবন ফুরিয়ে আসছে।
১৯ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেই রোমহর্ষক কিছু তথ্য। হাদি বলে গিয়েছিলেন, হারাম খেয়ে শরীর ভারী করেননি। তাই তাঁর মৃত্যুর পর রাজকীয়, স্পেশাল কফিনের প্রয়োজন নেই। হালাল রক্ত আর হাসিমুখ….এই দুটি জিনিস নিয়েই তিনি আল্লাহর দরবারে পৌঁছবেন। হাদির এই শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করা হচ্ছে রাষ্ট্রের তরফে। ডক্টর মহম্মদ আবদ্দুল আহাদ নিশ্চিত করেছেন, সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করেই ওসমান হাদির মরদেহ দেশে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের বিজি ০৮৫ বিমানে যখন তাঁর দেহটি ঢাকাতে আসে, তখন হাজার হাজার সমর্থক হাজির হন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শাহাজালাল বিমানবন্দরে।
শনিবার তাঁকে দাফন করা হবে বলে জানা যায়। ওসমান হাদির আরও একটি শেষ ইচ্ছে ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর বাবার কবরের পাশে তাঁকে যেন রাখা হয়। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার খাসমহল এলাকাতে হাদির বাড়ি। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাদির শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী সেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তাঁর বাবার পাশের কবরে তাঁকে শায়িত করা হবে। তবে হাদির মৃত্যুর পর দেশের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বৃহস্পতিবার রাতে হাদির মৃত্যুর খবর এলে বাংলাদেশ ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতি উস্কে দেয়। সংবাদমাধ্যমের দফতর থেকে সরকারি বেসরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা হয়। সাংবাদিক থেকে সাধারণ যুবককে হত্যা করা হয়। অনেকেই বলছেন, হাদির চলে যাওয়াতে শিক্ষার্থীদের আবেগ বাঁধ ভেঙেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হলের নামফলক মুছে সেখানে সাঁটানো হয়েছে নতুন নাম শহীদ ওসমান হাদি হল। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসেনি। তবে শিক্ষাথীরা নিজেদের মত করে এই ফলক লাগিয়েছে।
এদিকে ওসমান হাদির তৃতীয় ইচ্ছে ছিল, তিনি একটি জনসমাবেশে বলেন, যদি আমার বুকে কিংবা আমার মাথায় গুলি চালানো হয়, তবে রাষ্ট্রের কাছে আমার শেষ চাওয়া হল, সেই অপরাধী বা ঘাতককে যেন গ্রেফতার করা হয়। কাকতালীয়ভাবে হাদির কথায় ফলেছে। তাঁর মাথাকে লক্ষ্য করেই গুলি চালানো হল। কিন্তু এর বিচার কি হবে? ঘাতক হাদিকে গুলি করার পর তার গতিবিধি, কোথা থেকে গিয়ে কোথায় পালাল, সবটাই জানতে পেরেছে। কিন্তু তাকে এখনও ধরতে পারেনি প্রশাসন। এমনকি তারা নাকি এই খবরও পেয়েছে, হারোয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে সে ভারতে পালিয়ে গিয়েছে। রাষ্ট্র পারেনি হাদির ঘাতককে গ্রেফতার করতে।
ওসমান হাদির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক হিসাবে ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ঘোষণা করেন, শনিবার সমস্ত সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেশের পতাকা অর্ধ নমিত করে রাখা হবে। মন্দির, মসজিদ, গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা হাদির পরিবারের জন্য সমবেদনা জানিয়েছেন। এমনকি তাঁর স্ত্রী, ও সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এতকিছুর পরও ওসমান হাদির তৃতীয় ইচ্ছে কি পূরণ হবে, পূরণ করতে পারবে দেশের প্রশাসন, এখন সেটার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে সবাই।












Discussion about this post