গত জুলাই-অগাস্টের পর থেকে পদ্মাপার থেকে কম উস্কানি দেওয়া হয়নি। সাউথব্লক ঠাণ্ডা মাথায় সেই সব উস্কানি সহ্য করেছে। শান্ত মাথায় ঢাকাকে সংযত হওয়ার কথা বলেছে। কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে তো বটেই। পাশাপাশি দিল্লি থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করেও বলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা যেন কোনওভাবেই দিল্লিকে অশান্ত করার চেষ্টা না করে। তাতেও হয়নি। লালকেল্লায় ঘটিয়েছে বিস্ফোরণ। সে দেশ চলছে পাকিস্তান সেনার অঙ্গুলি হেলনে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে যে নির্দেশ যাচ্ছে, ঢাকা সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। কিন্তু এবার তারা যেটা করল সেটা এককথায় বাড়াবাড়ি। ঘোমটা সরিয়ে খেমটা নাচ শুরু করল। বিশ্ব জেনে গেল ভারতের এই পাশের রাষ্ট্র আসলে প্রতিবেশী নয়, প্রতিক্রম। সাউথব্লক কতটা ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারে, সেটাই দেখার।
অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আলফা (স্বাধীন)-এর প্রধান পরেশ বরুয়া ঢাকায় রয়েছে বলেই ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের কাছে খবর এসেছে। জামায়াতে ইসলামির অনুগত চূড়ান্ত ভারত-বিদ্বেষী কয়েকজন প্রাক্তন সেনাকর্তার সঙ্গে তিনি আলোচনাও সেরেছেন। তবে পরেশের সাবেক সহচর আত্মসমর্পণকারী আলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার দাবি – ‘আমার ধারণা, এটা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সাজানো কাহিনি। পরেশ বাংলাদেশে যাননি।’ পরেশের সঙ্গে তাঁর মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হয় জানিয়ে অনুপের দাবি, ‘উনি ঢাকায় গেলে ঠিকই খবর পেতাম।’
ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অবশ্য খবর, বাংলাদেশের সেনা-গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর কয়েকজন অফিসার দিন চারেক আগে আলফা (স্বাধীন)-এর সর্বাধিনায়ক পরেশ বরুয়াকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে এই খবরকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘পরেশ বরুয়াকে আলোচনার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার অর্থ উত্তর-পূর্বাংশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি এখন আর শুধু হুমকির পর্যায়ে নেই, বাংলাদেশের শক্তিশালী একটি ভারত-বিদ্বেষী অংশ তা বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।’ তাঁর সংযোজন, ‘পরেশ কেবলমাত্র আলফা-র সর্বাধিনায়ক নন, উত্তর-পূর্বের প্রতিটি রাজ্যের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। সুতরাং, শিলিগুড়ি করিডর পেরিয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে উত্তর-পূর্ব ভারতের যে সাতটি রাজ্যকে ভারত থেকে আলাদা করার হুমকি বাংলাদেশের কিছু প্রাক্তন সেনাকর্তা এবং ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলি দিচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করার উপযুক্ত লোক হতে পারেন পরেশ বরুয়াই।’
সূত্রের খবর, রবিবার তাঁকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বনানীর ৫ নম্বর রোডে ডিজিএফআই-এর নজরবন্দি একটি নিরাপদ আশ্রয়ে তোলা হয়েছে। সেখানে যাঁদের সঙ্গে পরেশ দেখা করেছেন, তাঁদের অন্যতম গোলাম আজমের পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুল্লাহিল আমান আজমি এবং মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। রেজ্জাকুল হায়দার চিন থেকে বাংলাদেশের মাধ্যমে আলফার জন্য অস্ত্রশস্ত্র আনার প্রধান কারিগর ছিলেন। চট্টগ্রামে শিল্প দপ্তরের জেটিতে ১০ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র খালাসের মামলায় পরেশ বরুয়ার সঙ্গে এই রেজ্জাকুল হায়দারও আসামি ছিলেন। মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের আমলে ওই মামলা থেকে তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই রেজ্জাকুল চিনে গিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিদের জন্য আবার অস্ত্রশস্ত্র আনার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন বলে খবর পেয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। সেই রেজ্জাকুল হায়দারের সঙ্গে পরেশ বরুয়ার আলোচনার খবরে উদ্বেগ বেড়েছে নয়াদিল্লির।
খানিক সময়ের জন্য টাইম মেশিনে চেপে চলে যাওয়া যাক। সেটা ১৯৭৯-য়ের কথা। ভারতের বুকে তৈরি হয়েছিল একটি গেরিলা গোষ্ঠী। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন অসম। গোষ্ঠীর নাম দেওয়া হয় ‘ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম’। দু দশক ধরে তারা ভারতের বুকে চালিয়ে গিয়েছে সন্ত্রাসী হামলা। চেয়ারম্যান ছিলেন অভিজিত অসম। কম্যান্ডার ইন চিফ ছিলেন পরেশ বড়ুয়া। উলফা নেতাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে আত্মগোপনে চলে আসে। ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। এবং কেউ কেউ বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। এরপর বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার তাদের হস্তান্তরের জন্য উলফা বিষয়ে বিভিন্ন সময় বৈঠকের আয়োজন করে। ২০০৯ অরবিন্দ রাজখোয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে আলফার একটি চুক্তি সই হয়। তারা সমঝোতায় আসে। যদিও ব্যতিক্রম থেকে গিয়েছেন পরেশ বড়ুয়া। তার নাগাল পায়নি ভারত। বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং ভূটান থেকে তারা নাশকতা চালিয়ে গিয়েছে। ২০০০ সালে অস্ত্রসহ তিনটি ট্রাক ধরা পড়ে বাংলাদেশে। সেই সঙ্গে পরেশ বড়ুয়াও। তাকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়।
গুয়াহাটিতে থাকা সাবেক আলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে এ দিন ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরেশের বাংলাদেশে যাওয়ার খবরকে বলেন ‘অ্যাবসার্ড’। তাঁর যুক্তি, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে একাধিক মামলায় প্রাণদণ্ড হয়েছে আলফা (স্বাধীন)-এর এই সর্বাধিনায়কের, যা কার্যকর হয়নি। এই অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে পরেশ বাংলাদেশ যাবেন না। তিনি বলেন, ‘পরেশ যথেষ্ট বুদ্ধিমান। এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়া। এখন যদি আমাকে বাংলাদেশে যেতে বলা হয়, এমন পরিস্থিতিতে কি আমি যাব?’












Discussion about this post