২০২৫ সাল বাংলাদেশের জন্য খুব চ্যালেঞ্জয়িং হতে চলেছে, এ কথা বলাই বাহুল্য। এই বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হবে আন্তর্জাতিক চাপকেও। কারণ জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখ মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আন্তর্জাতিক মহলের কৌতূহল থাকবে প্রচারের সময়ই ট্রাম্প যে ভাষায় বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনুসের তদারকি সরকারকে হুমকি দিয়েছিলেন, পদে বসার পর তাঁর রূপ কি হতে চলেছে সেটা দেখার জন্য। প্রসঙ্গত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ট্রাম্প সরাসরি বাংলাদেশে ঘটে চলা হিন্দুদের উপর ধারাবাহিক নির্যাতন নিয়ে সরব হন। তিনি বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট থাকলে এটা হতে দিতাম না। উল্লেখ্য, মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক একেবারেই খারাপ। অপরদিকে ইউনুস মার্কিন ডেমোক্রেটিক দলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে মুহাম্মদ ইউনুস বিপুল পরিমান আর্থিক সাহায্য আদায় করেছিলেন বাংলাদেশের জন্য। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, ট্রাম্প এসেই সেই অনুদান বন্ধ করতে পারেন। পাশাপাশি ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে আরও কড়া কোনও সিদ্ধান্ত নিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, এটা বলাই বাহুল্য।
অপরদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসলেই চিন ও পাকিস্তান নানা কারণে চাপে পড়বে। যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও আসবে। কারণ, ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত সম্পর্ক অতি মধুর ও বন্ধুত্বপূর্ণ। আবার প্রস্তাবিত ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকেই ভারত বন্ধু ও চিন-পাকিস্তানের বিরোধী বলে পরিচিত। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতি অনেকটাই ভারত নির্ভর হবে, এটা বলাই যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভারত বিরোধিতার অনেকটাই নরম করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ইউনুস প্রশাসনকে এই কাজ কতটা করতে দেবে সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ ইউনুসের সামনে। অপরদিকে জানুয়ারির পর থেকে ভারতও বাংলাদেশকে বাড়তি চাপ দিতে শুরু করবে এটাও মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বাংলাদেশের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হল আরাকান আর্মির উত্থান। ২০২৫ সালে যা বড় আকার নিতে পারে। ইতিমধ্যেই চট্টগ্রামের কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনের খুব কাছেই ঘাঁটি গেড়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যোদ্ধারা। এদের মোকাবিলা করার উপায় খুঁজতে হবে মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসনকে। যা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
তবে ২০২৫ সালে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জেটির মুখোমুখি হতে হবে, তা হল অর্থনীতির হাল ফেরানো। কারণ অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, টাকার বিপরীতে বাড়তে থাকা ডলারের দাম এবং আর্থিক খাতে যে সংকট ২০২৪ সালে দেখা গিয়েছে, তা ২০২৫ সালেও বাংলাদেশকে বেশ ভোগাবে বলেই মত বিশ্লেষকদের। ইতিমধ্যেই ২০২৪-২৫ অর্হবছরে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ।আর সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছুঁতে পারে নয় দশমিক সাত শতাংশ। যার মোকাবিলা কড়া অবশ্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে। এর ওপর আছে দেশের রিজার্ভ সংকট। যা অবস্থা বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ কোনও ভাবেই ২০-২২ বিলিয়নের ওপরে যাচ্ছে না। এছাড়া ব্যাঙ্ক খাতে অস্থিরতার প্রভাব থাকবে সামনের বছরও। বিশেষ করে টাকা ছাপিয়ে ব্যাঙ্কগুলিকে উদ্ধার করার যে নীতি বাংলাদেশের তদারকি সরকার নিয়েছে, তার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের দাবি, একটা বড় সমস্যা হল বিনিয়োগ বাড়ছে না। বাংলাদেশের জি়ডিপি ২২ থেকে ২৪ শতাংশে স্থির হয়ে আছে। ফলে জিডিপির হার যদি ৪০ শতাংশে পৌঁছে দেওয়া না যায় তবে বাংলাদেশের হাল আরও বেহাল হতে পারে বলেই ইঙ্গিত। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতির অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কি করেন সেটাও দেখার বিষয়।
৫ আগস্টের পর থেকে পাঁচ মাস কেটে গেলেও বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হয়নি। বরং তা দিনে দিনে চরম অবনতির দিকে রয়েছে। চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, লুটপাট, চাঁদাবাজির অভিযোগ বেড়েই চলেছে। যা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও স্বীকার করে নিচ্ছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অমানুসিক নির্যাতনের অভিযোগও সেঞ্চুরি পার করে ডবল সেঞ্চুরির পথে। সবমিলিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করার চ্যালেঞ্জও রয়েছে সামনের বছরে। কারণ, ইউরোপীয় দেশগুলি এবং আমেরিকা বারবার মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিকঠাক করার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু কার্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের পুলিশবাহিনী এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরদিকে মব জাস্টিস প্রথার উত্থান হচ্ছে ক্রমাগত। বাংলাদেশে মব জাস্টিসের নামে চুরান্ত অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবেই বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। তবে মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল দেশে জাতীয় নির্বাচন করানো। যদিও তিনি ঘোষণা করেছিলেন ২০২৫ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশে নি্র্বাচন হবে। কিন্তু এই ব্যাপারে ছাত্রনেতারা এবং জামাতের সঙ্গে মতোবিরোধ তৈরি হয়েছে বিএনপি-র মতো রাজনৈতিক দলগুলি। তাঁরা চায় দ্রুত নির্বাচন। অপরদিকে ছাত্রনেতারা চাইছেন সার্বিক সংস্কার। এই দুই পক্ষকে সামলে নির্বাচন করানো মুহা্ম্মদ ইউনূসের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। কারন আন্তর্জাতিক মহলও চাপ দিচ্ছে দ্রুত সুষ্ঠ ও সার্বিক নির্বাচন করানোর জন্য।
Discussion about this post