বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত দেড় মাসে কমপক্ষে দুটি সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করার জন্য। এমনটাই দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশের একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্য থেকে। এমনও জানা যাচ্ছে, ওয়াকার উজ জামানের গত ১১ মে থেকে শুরু হতে যাওয়া পাঁচ দিনের মার্কিন সফরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।
বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে যে, জেনারেল ওয়াকার উজ জামান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ল্যান্ড ফোর্সেস প্যাসিফিক সিম্পোজিয়াম এবং এক্সপোজিশনে আমন্ত্রিত ছিলেন। জানা যাচ্ছে তাঁকে মৌখিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে না যেতে সতর্ক করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু ১১ মে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের যে ফ্লাইটে আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের সেটিকে গ্রাউন্ডেড রাখা হলেও পরে তাতে ওঠেননি সেনাপ্রধান। সূত্রের থবর, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসান ১১ মে সন্ধ্যা ৭:৩৫ নাগাদ ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সাথে দেখা করেন। এবং ওই বৈঠকটি প্রায় ২ ঘণ্টা হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, ওয়াকার উজ জামানের মার্কিন সফর বানচাল করতে আসরে নেমেছিল ইউনূস স্বয়ং। ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় ইউনূসের কার্যালয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্টের চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনার সারাহ কুক, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, অস্ট্রেলিয়ার হাই কমিশনার সুসান রাইল এবং কানাডার হাই কমিশনার অজিত সিংয়ের মতো নিজ নিজ মিশন প্রধানরা ইউনূসের সাথে দেখা করেন। তবে এই বৈঠকটি ঠিক কি কারণে হয়েছে তা খোলসা করেনি ইউনূস প্রশাসন। তবে ওয়াকার উজ জামানের মার্কিন সফর বাতিল হওয়ায় আয়োজকরাও তাঁর কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। চার দিনের এই সম্মেলনটি ১১ মে হাওয়াইয়ের হনোলুলুতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। যদিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সূত্রে জানা যাচ্ছে, জেনারেল ওয়াকার উজ জামান খুব শীঘ্রই এক মাসব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন এবং সেখান থেকে হজে যাবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের পাঁচ দিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু আচমকা তাঁর এই সফর বাতিল অনেক প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল।
এই আবহেই জানা যাচ্ছে, ঢাকায় নিযুক্ত পাক হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ অপ্রত্যাশিতভাবে ছুটিতে গিয়েছেন, যা কূটনৈতিক মহলে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হচ্ছে, পাক হাইকমিশনার হানিট্র্যাপের শিকার হয়েছেন এবং তাঁর পর্দাফাস হয়ে যাওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফের গত ৮ মে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন এবং কিছু রোহিঙ্গা নেতার সাথে ‘জুম্মার’ নামাজ আদায় রাখাইন প্রদেশে ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপনের প্রস্তাবিত বিতর্কের প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। একদিকে বাংলাদেশ সরকার এবং সেনার একটা অংশ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করছে রাখাইনে আরাকান আর্মিকে মানবিক করিডোর দিয়ে মিয়ানমারের জুন্টা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। অন্যদিকে পাক হাইকমিশনার কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে জুম্মার নমাজ পরছেন। সূত্রের খবর, ঢাকায় নিযুক্ত পাক হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ গত চার মাসে তিনবার কক্সবাজার সফর করেছেন। উল্লেখ্য তিনি পাকিস্তানি হাইকমিশনের আরও দুই শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে গত ৬ এবং ৭ ফেব্রুয়ারি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি এবং জামায়াতে ইসলামীর আমিরের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলেছেন, পাকিস্তানি হাইকমিশনারের কক্সবাজার সফর অস্বাভাবিকভাবে গোপনীয় ছিল। যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হয়েছিল। ওই সূত্র আরও দাবি করেছে, এটি “সম্ভাব্য রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কার্যকলাপের জন্য” আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি এবং অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী সংগঠনগুলিকে “সক্রিয়” করার লক্ষ্যে “সমন্বিত প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়”। এবার জানা যাচ্ছে, ওই পাক হাইকমিশনারই হানিট্র্যাপের শিকার হয়ে দ্রুত দেশ ছেড়েছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ সেনাপ্রধানও তাঁর মার্কিন সফর বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। সবমিলিয়ে রাখাইন প্রদেশে মানবিক করিডোর নিয়ে পরিস্থিতি দ্রুত বদল হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, প্রচলিত রেওয়াজ অনুসারে কোনও দেশের রাষ্ট্রদূত কর্তব্যরত অবস্থায় ছুটিতে গেলে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রককে সে বিষয়ে জানিয়ে রাখেন। তিনি কত দিনের ছুটি নিচ্ছেন, ওই সময়ে কে দায়িত্বে থাকবেন, তা বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রককে জানাতে হয়। উল্লেখ্য গত রবিবার প্রথমে বাংলাদেশ ছাড়েন পাক হাইকমিশনার এবং তারপরে পাকিস্তানি হাই কমিশনের তরফে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রককে বিষয়টি জানায়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে হাসিনা পরবর্তী সময়ে অতিসক্রিয় পাক হাইকমিশনারের বিরুদ্ধে ওঠা হানিট্র্যাপের অভিযোগ এবং পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে অপারেশন সিঁদূরের আতঙ্কেই কি পাকিস্তান এই সিদ্ধান্ত নিল?
Discussion about this post