২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশ উত্তাল, চূড়ান্ত অরাজক পরিস্থিতি। সদ্য দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে কোনও আইনের রাজত্ব নেই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সেদিন তিনি স্পষ্ট ও দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন আজ থেকে তাঁর কাঁধেই জাতির ভালো-মন্দের দায়িত্ব। মজার বিষয় হল, সেদিনই হয়তো তাঁর নাম অধিকাংশ বাংলাদেশি প্রথমবার শুনেছিলেন এবং তাঁকে প্রথমবার দেখেছিলেন টেলিভিশনের পর্দায়। কারণ তিনি মাত্র কয়েক মাস আগেই সেনাপ্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৮তম সেনাপ্রধান হিসেবে ২৩ জুন ২০২৪ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে তাঁকে আম নাগরিকদের অনেকেই চিনতেন না। তবে তাঁর সেদিনের ভাষণে সকলেই আশ্বস্ত হয়েছিলেন। দেশের সেনাপ্রধান যখন বলছেন তাদের ভালো-মন্দের দায়িত্ব তার কাঁধে ফলে যা হওয়ার ভালোই হবে। এটাই ছিল বিশ্বাস। যদিও পরবর্তী তিন দিনে বাংলাদেশ ছিল মূলত মগের মুলুক। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলতা অরাজকতা ও একটা হত্যাভূমি। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নিলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জ্জামান সেদিনও ইউনূসের পাশে ছিলেন। ফলে বাংলাদেশবাসী আরও আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু দশ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর কেন আচমকা পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে দিল? কেন জেনারেল ওয়াকার বাংলাদেশের জনগণের আস্থা হারাচ্ছেন? এই প্রশ্নগুলোই এখন আম বাংলাদেশীদের মনে ঘোরাফেরা করছে।
একদিকে মিথ্যা তথ্য প্রচার ও অন্যদিকে ক্রমাগত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসন দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ভীষণরকম দুর্বল। শিল্প কলকারখানা সব ধুঁকছে, বাড়ছে বেকারত্ব। জিনিসপত্র ও আনাস পাত্তির দাম ক্রমশ বেড়েই চলেছে, কমেনি চাঁদাবাজি ও জুলুমবাজির ঘটনা। উল্টে যে জিনিসটা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একেবারেই ছিল না সেই মব সংস্কৃতি বা মব জাস্টিসের ঘটনা থামানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে “মব” কারা? রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের একটা বড় অংশ দাবি করছেন যারা শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো, সেই গোষ্ঠীর একাংশই এখন মব জাস্টিসের নামে বাংলাদেশে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। বিগত ৫ আগষ্টের পর থেকে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কার্যত ভেঙে পড়েছিল। আর সেই সুযোগে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটা বড় অংশ মব জাস্টিসের নামে যত্র তত্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে গিয়েছে। জায়গায় জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতা ও বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগীদের মারধোর, গণধোলাই বা তাঁদের বাড়িঘর, ব্যবসাপত্র ভাঙচুর ও লুটপাট করে গিয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায় যে বাংলাদেশের জনগণ অতিষ্ট হয়ে ওঠে। তখনই বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান ফের গর্জে উঠেছিলেন।
মুশকিল হল, জেনারেল ওয়াকার বারবার গর্জেছেন, কিন্তু প্রয়োজনমতো বর্ষাননি। ফলে যা হওয়ার তাই হল, পরিস্থিতি যে কে সেই রয়ে গেল। মব জাস্টিসের নামে কিছু উন্মত্ত জনতা, যাদের তৌহিদী জনতা নামে ডাকা হয়, তাঁরা আইনের উর্দ্ধেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষ যখন অতিষ্ট হয়ে উঠছে, সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। তখন দেওয়াল লিখন পড়তে পারেননি জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। তাই তিনি মাঝেমধ্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন, আর গরম গরম কথা বলেন। সাধারণ মানুষ ভাবেন, এই বুঝি সুদিন এল। কিন্তু না, কিছুই আসেনি। এবার সেনাপ্রধান বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, মব জাস্টিস মিটাতে হবে। সেনাবাহিনীও সক্রিয় হল, কিন্তু মব জাস্টিস থামানো যায়নি। বরং আদালতের ভিতর উন্মত্ত জনতা তান্ডব চালালেন, ছাড় পেলেন না বাংলাদেশের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকও। ফলে প্রশ্ন উঠছে সেনাবাহিনীর সক্রিয়তা নিয়ে, প্রশ্ন উঠছে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের দৃঢ়তা নিয়ে। সেনাপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেমন হতাশ, তেমনই হতাশ সেনাবাহিনীর জওয়ানরাও। সকলেরই আস্থা হারিয়ে ফেলছেন জেনারেল ওয়াকার উজ জামান।
Discussion about this post