পুরীর সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে দিঘা। দুটোই বাঙালির অতি প্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য। পুরীতে সমুদ্রস্নানের মজার সঙ্গে ছিল ভক্তিরসে ডুব দেওয়ার আনন্দ। কারণ অবশ্যই জগন্নাথ ধাম। দিঘাতে শুধুই জলকেলীর মজা। ভক্তির ছিটেফোঁটা ছিল না। এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় সেটাও পাওয়া যাচ্ছে। তৈরি হয়েছে বিশাল জগন্নাথ মন্দির। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু হিন্দু ভাবাবেগ নিজের দিকে টানতে শুরু করলেন বাড়ি বাড়ি মহাপ্রসাদ বিলি! জন্ম নিল এক মহাবিতর্ক। একেই কি ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয়, নাকি হিন্দুদের ধর্মীয় রীতিকে তাচ্ছিল্য করা?
বাঙালির ভ্রমণ বলতে শুধুই ছিল দি-পু-দা। অর্থাৎ দিঘা-পুরী-দার্জিলিং। এরমধ্যে দিঘা ও পুরী হল সমুদ্র সৈকত আর দার্জিলিং বিশুদ্ধ হিমালয়। আপাতত বাঙালির পাত থেকে দার্জিলিং বাদ। শুধুই দিঘা-পুরীর লড়াই চলছে, অনুপ্রেরণায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, তিনি পুরীর জগন্নাথ ধামের আদলে দিঘায় সুউচ্চ এক জগন্নাথ মন্দির নির্মান করিয়েছেন। সমুদ্রের ধারেই সেই স্বেতশুভ্র মন্দির দর্শনে এখন দিঘায় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রব। হোটেলগুলি পরিপূর্ণ, যাও দুই একটা পাওয়া যায় সেটাও আকাশছোঁয়া দাম। এখন তো বাড়িতে একটা ঘর বাড়তি থাকলে সেটাও ভাড়া দিয়ে দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ, এবারই প্রথম দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে হবে রথযাত্রা। সাজ সাজ রব চারদিকে। দুদিন আগেই পৌঁছে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবকিছু নিজেই তদারকি করছেন ঘুরে ঘুরে। এই আবহে তাঁর অনুপ্রেরণায় যে পশ্চিমবঙ্গের বাড়ি বাড়ি দিঘার জগন্নাথ ধামের মহাপ্রসাদ বিলির কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে তা নিয়ে চলছে বিপরীতমুখী এক বিতর্ক। আসুন দৃষ্টিতে ভঙ্গি খানিকটা ককটেলের সঙ্গে গুলিয়ে নিয়ে এই আলোচনা করা যাক। আদৌ কি এটা মহাপ্রসাদ?
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক পুরীর জগন্নাথের ভোগকে কেন মহাপ্রসাদ বলা হয়। সবটার উত্তর রয়েছে পুরাণে। অর্থাৎ সেই পৌরাণিক যুগে এই মহাপ্রসাদের জন্ম। জগন্নাথ দেবের প্রসাদ রূপান্তরিত হবে মহাপ্রসাদে। কীভাবে? উত্তর খুঁজি পুরাণে। দেবী বিমলা প্রভু জগন্নাথকে তাঁর মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন একটি শর্তে। জগন্নাথ দেবকে নিবেদিত অন্নভোগ পরিচিত হবে ‘প্রসাদ’ নামে। এইবার সেই প্রসাদ নিবেদিত হবে বিমলার কাছে। বিমলা গ্রহণ করার পর প্রসাদ রূপান্তরিত হবে ‘মহাপ্রসাদে’। এই মহাপ্রসাদে আচণ্ডালের অধিকার। চণ্ডাল এবং ব্রাহ্মণ একসঙ্গে এই প্রসাদ গ্রহণ করলেও স্পর্শদোষে উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র হবে না। শেষতম কণিকাটিও সমানভাবে পবিত্র থাকবে। জগন্নাথ দেব দেবী বিমলার শর্ত মেনে মন্দিরে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠিতও হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের বহু আগে থেকেই সেটা বিমলাক্ষেত্র নামে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী বিমলার অধিষ্ঠান ছিল। আর জগন্নাথ দেবের প্রসাদ প্রকৃতই মহা-প্রসাদ। স্বয়ং ব্রহ্ম। সারা ভারতের মানুষের কাছে একটি মহাবস্তু। তাঁরা বিশ্বাস করেন, স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী রন্ধন করেন আর রত্নবেদিতে দাঁড়িয়ে দেবতারা গ্রহণ করেন। তাহলে কেন দিঘায় সদ্য নির্মিত এক মন্দিরের প্রসাদকে মহাপ্রসাদ বলে চালানো হবে? এটাই হল সোনার পাথরবাটি। এটাই হল ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, হিন্দুদের ধর্মীয় রীতিকে তাচ্ছিল্য করা হল না কি? বিজেপির অভিযোগ, কোনও কোনও এলাকায় এই বরাত পেয়েছে মুসলমান ব্যবসায়ীরাও। তাঁদের মূল অভিযোগ, তৃণমূল কংগ্রেস উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হিন্দু ভাবাবেগকে আঘাত করছে। পাশাপাশি তাঁরা এই ধরণের উদ্যোগকে ভিত্তিহীন বলে এর বিপূল খরচের প্রসঙ্গও তুলছেন।
দিঘার মহাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি বাড়িতে রেশনের মাধ্যমে বিলি করা হচ্ছে। আর তাঁর জন্য টেন্ডার ডেকে বিভিন্ন মিস্টির দোকানকে মহাপ্রসাদের গজা ও প্যারা তৈরির বরাদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে দিঘা থেকে কলকাতা পর্যন্ত তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে ব্যানার-পোস্টার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রথযাত্রায় এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন দিঘায় প্রথমবার রথের রশিতে টান দেবেন। তেমনই তাঁকে একফোঁটা রাজনৈতিক জমি না দেওয়ার জন্য বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী দুটি কর্মসূচি ঘোষণা করে দিয়েছেন। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে তৃণমূলের নেতামন্ত্রীরা বাড়ি বাড়ি দিঘার মন্দিরের মহাপ্রসাদ পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
Discussion about this post