শুরু হয়ে গিয়েছে গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ। যাকে আমরা অলিম্পিক গেমস বলে চিনি। ২০২৪ সালের অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফ্রান্সের ঐতিহাসিক শহর প্যারিসে। এবারের অলিম্পিক গেমসে ২০৬টি দেশের মোট ১০ হাজার ৭১৪ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহন করছেন। কিন্তু বিশাল এই পৃথিবীতে এমনও কয়েকজন প্রতিযোগী রয়েছেন, যাদের না আছে কোনও দেশ, না আছে কোনও সুস্থ পরিচয়। তাঁদের আজ একমাত্র পরিচয় উদ্বাস্তু বা শরণার্থী। কিন্তু আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটি তাঁদেরও গেমসে অংশগ্রহন করার সুযোগ করে দিয়েছে। যা এককথায় অসাধারণ উদ্যোগ। এবার আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটির অধীনে উদ্বাস্তু দলে রয়েছেন ৩৭ জন প্রতিযোগী। যারা এগারোটি দেশের একদা নাগরিক ছিলেন, কিন্তু এখন উদ্বাস্তু জীবনযাপণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। জানিয়ে রাথি, উদ্বাস্তু দলের পতাকার নীচে এই ৩৭ জন প্রতিযোগী ১২টি বিভাগে পদকের জন্য লড়বেন।
শুক্রবার প্যারিস অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হল অভিনব উপায়ে। কোনও স্টেডিয়ামের ভিতর নয়, বরং প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে স্যেন নদীতে নৌকায় চেপে মার্চ পাস্ট হয়েছে। প্র্ত্যেকটি দেশের প্রতিযোগীরা নিজের নিজের দেশের পকাতা হাতে স্যেন নদীর উপর নৌকা বা বড় লঞ্চে চেপে মার্চ পাস্টে অংশ নিয়েছেন। দেশ কিংবা জাতীয় পতাকা না থাকলেও শরণার্থীদের আলাদা পতাকা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটি। যখন উদ্বাস্তু বা শরণার্থী দলের সেই আলাদা পতাকা হাতে ওরা ৩৭ জন একটি আলাদা নৌকায় শহরের কেন্দ্রস্থলে এলেন। তখন উল্লাসে ফেটে পড়লেন নদীর ধারে অপেক্ষারত দর্শকরাও। প্রত্যেকেই তাঁদের সাহসীকতা এবং ধৈর্যের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হলেন এবং অভিবাদন জানালেন। ওই উদ্বাস্তু দলের পতাকাবাহক ছিলেন ক্যামেরুনের বক্সার সিন্ডি এনগাম্বা। তাঁর প্রত্যয়ী বক্তব্য, “আমাদের সকলকে উদ্বাস্তু হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সবকিছুর উপরে আমরা একেকজন খেলোয়াড়। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত খেলোয়াড়। তাই আমরা সবাই একটা পরিবার”।
এরকমই একজন ক্রীড়াবিদ হলেন য়ুসরা মার্ডিনি। যিনি নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য অবিশ্বাস্য সব বাঁধা অতিক্রম করেছিলেন। তাঁকেও অলিম্পিক্স কমিটি সুযোগ করে দিয়েছে। য়ুসরা যুদ্ধবিদ্ধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিক। ২০১৫ সালে তিনি এক বোনকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর। দুই বোন প্রথমে লেবাননে আশ্রয় নেয় তারপর তুরস্কে চলে আসেন। এরপর একটি নৌকায় চেপে তুরস্ক থেকে গ্রিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। ১০ কিমি বিপদসঙ্কুল পথের মাঝপথেই নৌকাটি প্রায় উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ফলে য়ুসরা এবং তাঁর বোন জলে ঝাঁপ দেয়। এরপর নৌকাটি কার্যত ঠেলে তিনঘণ্টায় গ্রিসে পৌঁছোন তঁরা। গ্রিস থেকেও দীর্ঘ পথ হেঁটে জার্মানি যান য়ুসরা। তবে ভালো সাঁতারু হওয়ার সুবাদে য়ুসরাকে অলিম্পিক্স উদ্বাস্তু দলে সুযোগ দেওয়া হয়। ২০১৬ এবং ২০২০ অলিম্পিক্সে অংশ নিয়েছিলেন য়ুসরা মার্ডিনি। এবারও তিনি ১০০ মিটার বাটারফ্লাই সাঁতারে অংশ নেবেন।
এমনই এক লড়াকু ক্রীড়াবিদ মানিঝা তালাস। তিনি ব্রোকিং প্রতিযোগীতায় অংশ নেবেন। মানিঝা তালাসের জন্ম আফগানিস্তানে। বর্তমানে সেখানকার শাসক তালিবান মহিলাদের খেলাধুলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে মানিঝা পালিয়ে আসেন পাকিস্তানে। সেখান থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেন স্পেনে। আফগানিস্তানের আরেক ক্রীড়াবিদ ফারজাদ মানসৌরি। তিনি তায়কোন্ডাতে অংশ নেবেন উদ্বাস্তু দলের হয়ে। গত টোকিও অলিম্পিক্সে আফগানিস্তানের পতাকাবাহক ছিলেন ফারজাদ। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে এবার উদ্বাস্তু হয়ে প্যারিস অলিম্পিক্সে নামতে চলেছেন তিনি।
সামান সোলতানি, একজন ২৪ বছর বয়সী ক্যানোয়েস্ট। ইরানী নাগরিক সোলতানি এখন উদ্বাস্তু হিসেবে অস্ট্রিয়ায় থাকেন। তিনিও এবার পদকের অন্যতম দাবীদার। ২১ বছর বয়সী দৌঁড়বির পেরিনা লোকুর নাকাং। যার জন্ম দক্ষিণ সুদানে, কিন্তু থাকেন কেনিয়ার শরণার্থী শিবিরে। বাকি ক্রীড়াবিদরা অ্যাথলেটিক্স, ভারোত্তোলন, কুস্তি, জুডোর মতো প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে চলেছেন। এখন দেখার এঁদের মধ্যে কারা কারা পদক স্পর্শ করতে পারেন।
Discussion about this post