বিগত কয়েক বছরে নরেন্দ্র মোদির ভারত গোটা বিশ্বে নিজের আধিপত্য যতটা বিস্তার করেছে, ততটাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলির ওপর। পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যে কতটা শীতল, সেটা কাউকে না বলে দিলেও চলে। কিন্তু মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপালের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সম্পর্ক নানান উত্থান ও পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে একমাত্র বাংলাদেশ ছিল ভারতের প্রকৃত বন্ধু, কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশও এখন ভারতকে দূরে ঠেলতে ব্যাস্ত। যদিও ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলি, রাশিয়া ও আমেরিকা এখন ভারতকে সমীহের চোখেই দেখে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করতে পেরেছে। এর জেরেই ভারত তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলির ওপর আধিপত্য বিস্তার করার দিকে নজর দেয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের আধিপত্য বিস্তারের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় বাঁধা দিতেই নরেন্দ্র মোদি “গ্লোবাল সাউথ” কূটনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন। এর মাধ্যমে ভারত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে বিপুল বিনিয়োগ করতে শুরু করে। নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় বেশ কয়েকটি প্রকল্প শুরু করে। যা সেই দেশের পরিকাঠামোগত উন্নতি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সাহায্য করতে পারে। আর এর বদলে ভারতও কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়। যেমন, মিয়ানমারে কালাদান মাল্টি মডাল ট্রানজিট প্রজেক্ট। এই প্রকল্পে ভারত মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তেইয়ের নিকট একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে। পাশাপাশি কালাদান নদীতে ড্রেজিং করে নদীপথটিকে বাণিজ্য উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। এরপর পালতেয়া শহরে নদী বন্দর ও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে গড়ে তুলেছে। এই পালতেয়া থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্য ১০০ কিলোমিটারের কিছু কম। এই পথে ভারত ছয় লেনের একটি মহাসড়ক নির্মাণ করছে। ফলে উত্তর পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে শিলিগুড়ি করিডোর এড়িয়ে তিন হাজার কিলোমিটার পথ কমিয়ে কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে অতি সহজে পণ্য পাঠাতে পারছে।
কিন্তু মিয়ানমারে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং সামরিক জুন্টা শাসকের মধ্যে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে পরিস্থিতি অনেকটাই হাতের বাইরে চলে যায়। সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আরাকান আর্মি পুরো রাখাইন প্রদেশের দখল নিয়েছে সামরিক জুন্টা বাহিনীকে হঠিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরাকান আর্মি মূলত মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকানস-এর সামরিক শাখা হিসেবে কাজ করে। গত পনেরো মাসে, আরাকান আর্মি রাখাইন প্রদেশের কয়েক ডজন টাউনশিপ এবং সামরিক ফাঁড়ি দখল করেছে। এবার বাকি শুধু রাজধানী সিত্তেই। এহেন আরাকান আর্মির উত্থান ও অগ্রগতি ভারতের কাছে এক উটকো সমস্যা হিসেবে মাথাচাড়া দিয়েছে। কারণ, বিগত ২০ বছর ধরে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুর জাতিগত সমস্যায় জ্বলছে। আর মিয়ানমার থেকে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ শরণার্থীদের আগমন এই সমস্যাগুলিকে আরও জটিল করে তুলেছে। মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির হাতে উন্নত অস্ত্র ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির কাছে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।
এছাড়াও, তহবিল সংগ্রহের জন্য মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি মাদক পাচারের তৎপরতা বাড়িয়েছে, যা ভারতের জন্য আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয়। ঝুঁকি অনুধাবন করে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তের দু’পাশ থেকে মানুষের চলাচলের নিয়ম আরও কড়া করেছে। এই সীমান্তে ফ্রি মুভমেন্ট শাসনের অধীনে ১৬ কিলোমিটার এলাকা থেকে এখন উভয় দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকায় মানুষের চলাচলকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ভারত নিয়মিত আরাকান আর্মির কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে। চলছে নিয়মিত আলোচনা। যাতে সীমান্ত এলাকায় মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান কমানো যায়। এবং রাখাইন প্রদেশে চলমান কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট প্রজেক্ট সুরক্ষিতভাবে চালিয়ে যেতে আরাকান আর্মির সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এর জন্য ভারত মিয়ানমারে সামরিক জুন্টা শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে পুনরায় ফেডারেল এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছে ভারত। যা আরাকান আর্মি-সহ অন্যন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ণ।
Discussion about this post