চারিদিকে বিজয়ার সুর, মা দুগ্গা সপরিবার কৈলাসে ফিরেছেন। বছর ঘুরে প্রতিবারই এই দিনটা আসলে মন খারাপের পর্ব শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ১২ মাসে ১৩ পার্বনের গ্রাম বাংলায় উৎসবের শেষেও যে উৎসবের সূচনা হয় তা কি জানেন? প্রাচীন বঙ্গের বহু জায়গায় দুর্গা বিসর্জনের দিনই বেজে ওঠে বোধনের সুর। অর্থাৎ, দশমীতেই হয় বোধন। সারা রাজ্যের মানুষ যখন মা দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে বিষন্ন, তখন এই এলাকার বাসিন্দারা মেতে ওঠেন মায়ের আরাধনায়। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ার জেলা। এখানকার রাজবংশী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে ভাণ্ডানী দেবীর আরাধনার চল রয়েছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই। মা দুর্গার এক রূপ হলেন দেবী ভাণ্ডানী। তবে মা দুর্গার দশ হাত থাকলেও দেবী ভাণ্ডানীর দ্বিভূজা। আবার উত্তরবঙ্গেরই উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ এলাকার কয়েকটি গ্রামে দশমীতেই বোধন হয় দুর্গার আরেক রূপ দেবী বালাইচণ্ডীর। আর এই রীতি চলে আসছে ৫০০ বছরের বেশি আগে থেকে।
উত্তরবঙ্গের ভাণ্ডানী পুজোয় শুধুমাত্র রাজবংশীরাই নয়, বরং উৎসবে মেতে ওঠেন সব ধর্মের মানুষজনই। ভাণ্ডানী দেবী আসলে বনদূর্গা। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের বিস্তৃর্ণ জঙ্গলে বনদুর্গা রূপেই দেবী ভাণ্ডানীর পুজোর চল রয়েছে। সেই কারণেই দেবী দুর্গার মতো দেবী ভাণ্ডানীর বাহন সিংহ নয়, তাঁর বাহন বাঘ। দুর্গার মতো ভাণ্ডানী মূর্তিতে অসুরের দেখা মেলে না, তবে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্ণী এবং সরস্বতীর মূর্তি থাকে। উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলে দেবী ভাণ্ডানী পুজোর আবির্ভাব নিয়েও একটি লোকগাথা প্রচলিত রয়েছে।
কথিত আছে, দশমীর দিন বিসর্জনের পর দেবী দুর্গা সপরিবার কৈলাসের দিকে যাওয়ার পথে উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলের আদিবাসীরা মায়ের কাছে আর্তি জানান একটা রাত সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য। কারণ, এখানকার গ্রামীন জীবনে দুঃখ-দুর্দাশা ও অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। মা দুর্গা তাঁদের কাতর আর্জি মেনে নিয়ে একরাত সেখানে অবস্থান করেন। এবং একাদশীর দিন পুজো গ্রহন করে কৈলাসে ফেরেন। সেই থেকে ওই এলাকা ধণধাণ্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাড়িতে বাড়িতে শস্যভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই থেকেই মা দুর্গা হয়ে উঠলেন দেবী ভাণ্ডানী। ফলে প্রাচীন সেই রীতি মেনে দশমীর দিন মায়ের বোধন হয় এবং একাদশীর দিন পুজো হয়। এই অঞ্চলের কোনও কোনও পুজো শতাব্দী প্রাচীন।
অন্যদিকে, উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ শহরের ১৫ কিলোমিটার দূরে খাদিমপুর গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দারা একাদশীর দিন মেতে ওঠেন দেবী বালাইচণ্ডীর আরাধনায়। খাদিমপুরের দেবী দশভূজা নন, চতুর্ভুজা। হাতে দেবীর অস্ত্র থাকলেও এখানে দেবীর পদতলে নেই মহিষাসুর। তবে সঙ্গে থাকেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষী, সরস্বতী। গ্রামবাসীদের দাবি, ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে বালাইচণ্ডীর পুজো হয়ে আসছে। দশমীতে বোধন, আর একাদশী, দ্বাদশী ও তৃতীয়া পর্যন্ত চলে পুজো। এই চারদিন এখানে মেলাও বসে। বালাইচণ্ডী পুজোয় বলিপ্রথা রয়েছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। এখনও এখানে পাঠা ও পায়রা বলি হয়। তবে মায়ের ভোগে বলির মাংস দেওয়া হয় না।
Discussion about this post