বৃহস্পতিবার মাঝরাতে ওড়িশার ভিতরকণিকা অভয়ারণ্য এবং ধামারা বন্দরের মধ্যবর্তী স্থানে স্থলভূমিতে আছড়ে পড়েছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ডানা। যার ভয়ানক প্রভাব জনবসতিতে না পড়লেও কার্যত তছনচ হয়ে গিয়েছে লক্ষাধিক পাখির বাসা। বেঘোরে মারা পড়েছে প্রচুর সংখ্যক পাখি এবং পশুপাখি।
পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের মতোই ওড়িশার ভিতরকণিকাতেও রয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। বছর বছর বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একেকটি ঘূর্ণিঝড় হয় ওড়িশা বা অন্ধ্র উপকূলে আছড়ে পড়ে, তেমনই কোনওটা আবার এই বাংলা বা পড়শি দেশ বাংলাদেশের দিকে চলে আসে। কিন্তু পরিবেশবিদদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলজুড়ে যে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছড়িয়ে রয়েছে, তা অনেককাংশে রক্ষা করে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলা থেকে। এবারও অনেকটা তাই হল। ওড়িশার ভিতরকণিকা অভয়ারণ্য হল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। আর এই ম্যানগ্রোভ জঙ্গলই এবার বাঁচিয়ে দিল ওড়িশাকে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় ডানা অতি প্রবল গতি নিয়ে ঢুকে পড়েছিল স্থলভূমিতে। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু সেই আশঙ্কা নস্যাৎ করে ল্যান্ডফল হওয়ার পরও সেরকম কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসেনি, প্রাণহানির ঘটনাও নেই প্রায়। ওড়িশার মন্ত্রী সূর্যবংশী সূরজ জানিয়েছেন, ভিতরকণিকার ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জন্যই তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবার।
মানচিত্র লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, ধামরা বন্দরের উল্টোদিকের ৯টি দ্বীপ নিয়ে রয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ভিতরকণিকা। বরাবরের মতোই এবারও সেই ম্যানগ্রোভ অরণ্য রক্ষাকর্তার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে গেল মানব সমাজের সামনে। কিন্তু প্রকৃতির মারে রক্ষা পেল না পাখির দল। কারণ, ভিতরকণিকা অভয়ারণ্য মূলত ব্রাক্ষ্ণণী এবং বৈতরণী নদীর ব-দ্বীপে গড়ে উঠেছে। আয়তন প্রায় ৬৫০ বর্গ কিলোমিটার। রহস্যে ঘেরা, গাছগাছালিতে ভরা এই অরণ্যের গহনে লুকিয়ে কত শত নাম না জানা পাখি-প্রাণী। সরকারি গেস্ট হাউজ থেকে শুরু করে ইকো ট্যুরিজম পার্ক– ভিতরকণিকায় পেয়ে যাবেন সব কিছুই। কলকাতা থেকে ভদ্রক ট্রেনে সেখান থেকে গাড়িতে যাওয়া যায় ভিতরকণিকা। ফলে সারা বছরই এখানে বাঙালি পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে এখানে আসে প্রচুর পরিমান পরিযায়ী পাখি। তাঁরা এখানে বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে।
কিন্তু এবারের ঘূর্ণিঝড় ডানা সরাসরি আঘাত হেনেছে ভিতরকণিকায়। এখানকার সহকারী প্রধান সংরক্ষত মানস দাশ জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাসেই তাঁরা ভিতরকণিকায় পাখি সুমারি করেছিলেন। তিনি জানান, এখানকার প্রায় ১৩০০ গাছে ২৭,২৮২টি পাখির বাসা দেখতে পেয়েছিলেন। তাতে প্রায় এক লক্ষ ৩০ হাজার ১২৩টি পাখির ছানা পাওয়া গিয়েছিল। সহকারী বন সংরক্ষকের আশঙ্কা, এর মধ্যে অধিকাংশই শেষ হয়ে গিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ডানার দাপটে। তিনি আরও জানান, ভিতরকণিকা অভয়ারণ্যের মাঠদিয়াপ্রসাদ, দূর্গাপ্রসাদিয়া, লক্ষ্ণীপ্রসাদিয়া অঞ্চলে দু-দিন আগেও যেখানে পাখিদের কলরবে মুখরিত থাকতো, সেখানে আজ শ্মশানের নিরাবতা। এখানকার বন বিভাগের কর্তার দাবি, মূলত হিমালয়ান অঞ্চলের কয়েকশো প্রজাতির পাখি শীতের প্রাক্কালে উড়ে আসে। মূলত অক্টোবর মাসেই তাঁরা বাসা বেঁধে ডিম পারে। ফলে পাখিদের প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেল এবারের ঘূর্ণিঝড়ে। আবার ভিতরকণিকা কুমিরের অভরারণ্য হিসেবেও বিখ্যাত। চলতি বছরের শুমারি অনুযায়ী এখন ভিতরকণিকায় প্রায় ২০০০ কুমির রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অনেক কুমির এবং সাপ লোকালয়ে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ফলে শুক্রবার থেকে বনকর্মীরা বাড়তি নজরদারি চালাচ্ছে ভিতরকণিকার আশেপাশের লোকালয়ে।
Discussion about this post