বাংলার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য কালীমন্দির। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ, কয়েকটি মন্দিরের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আবার বেশ রোমহর্ষক। যার মধ্যে অন্যতম বীরভূমের আকালিপুর গ্রামের গুহ্যকালী।
গুহ্য শব্দের অর্থ, সাংসারিক গৃহস্থের কাছে যিনি অপ্রকাশিত। অর্থাৎ অতি গুপ্ত। কিন্তু আকালিপুর গ্রামের গুহ্যকালী কিন্তু সকলের আরাধ্যা, এই মন্দিরে সকলেই পুজো দিতে পারেন। তবে আকালিপুর গুহ্যকালী মন্দিরের ইতিহাস একেবারেই আলাদা। এই দেবীমূর্তিও অন্যান্য কালীমূর্তি থেকে আলাদা। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। তার ওপর সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার কালো কষ্টিপাথরের দেবী একটি প্যাঁচালো সাপের বেদীমূলের ওপর পা মুড়ে পদ্মাসনে বসে আছেন। যেহেতু দেবী গুহ্যকালী সাধকগণের আরাধ্যা, সেহেতু দেবীর এই রূপ ভাবনাও আলাদা। দ্বিভুজা দেবীর দেবীর বাম হাত ওপরে ও ডানহাত নীচের দিকে। যার সাহায্যে দেবী বর ও অভয় দান করছেন।
দেবী গুহ্যকালীর এই সর্পমূলাধার বেদী আসলে কূলকুণ্ডলিনীর প্রতীক। যা সাধকদের মুক্তির পথ প্রদর্শন করে। দেবীর মুখমণ্ডল হাস্যময়। বিরাট জিহ্বা আর দাঁত বের করে আছেন। দেবীর গলায় নাগহার রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে ৫০টি নরমুণ্ড মালারূপী বর্ণমালা। দেবীর কাঁধে নাগযজ্ঞ উপবীত। মাথায় জটা ও অর্ধচন্দ্র। কোমরে নাগকোটিবন্ধ। কান থেকে দুটি নরদেহ কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। দেবীর বাম কঙ্কণে সর্পরাজ তক্ষক। আবার বাম কঙ্কণ রয়েছে অনন্ত নাগরাজ। দেবীর বামদিকে বৎস্যরূপী শিব। মাথায় সহস্র ফণার নাগফণা মুকুট। দেবী নবরত্ন ভূষিতা। এই ধরণের কালীমূর্তি ভারতবর্ষে খুবই বিরল।
এবার আসি, মূল গল্পে। এই কালী মূর্তির ইতিহাস খুবই প্রাচীন। কথিত আছে, মগধরাজ জরাসন্ধ এই মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন। কালক্রমে বিভিন্ন রাজার হাতে পূজিতা হন দেবী গুহ্যকালী। এরপর কাশীরাজ চৈত সিংহের রাজত্বে এক কৃষক জমিতে এই দেবী মূর্তিটি খুঁজে পান। জানা যায়, এই সময়ে ব্রিটিশ শাসক লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের নজরে পড়ে মায়ের এই অপরূপ মূর্তি। ফলস্বরূপ তিনি কালী মায়ের এই মূর্তিটিকে ইংল্যান্ডের মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন। তাঁর এই গোপন পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে যান মহারাজা চৈত সিং। এর পরে তিনি মায়ের মূর্তিটিকে গঙ্গাবক্ষে নির্দিষ্ট স্থানে লুকিয়ে রাখেন। এরপর রটিয়ে দেন, মূর্তিটি চুরি গিয়েছে।
এর বহু বছর পর, মহারাজা নন্দকুমার মায়ের সপ্নাদেশ পান এবং কাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বাংলার মহারাজা নন্দকুমার কাশী গিয়ে মহারাজা চৈত সিংকে এই স্বপ্নাদেশের কথা বলেন। এরপর দুজনে মিলে অতি গোপনে সেই কালী মূর্তি উদ্ধার করেন গঙ্গাবক্ষ থেকে। এবং নৌকাযোগে নন্দকুমার সেই মূর্তি বাংলায় নিয়ে আসেন। নন্দকুমার সেই মূর্তি নিয়ে গঙ্গা নদী হয়ে দ্বারকা নদ ও ব্রাহ্মণী নদী পার করে চলে আসেন বর্তমান বীরভূমের আকালিপুর গ্রামে। এখানে ব্রাহ্মণী নদীতীরে শ্মশানের পাশে এক নিরিবিলি স্থানে ইটেরতৈরি আটকোনা অতি সাধারণ এক মন্দির স্থাপন করে মায়ের পুজো শুরু করেন। অতি সাধারণ কিন্তু অনন্য তন্ত্রশাস্ত্র সম্মত এই মন্দির। এখানে দেবীর নিত্যসেবা হয়।
অতি জাগ্রত এই মন্দিরের দরজা খোলা হয় সকাল ১০টায়। দেবীর পূজা প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে ১১টা ৩০ পর্যন্ত একবারই হয়। দুপুরে নিত্য ভোগপ্রসাদের ব্যবস্থা আছে। দুপুরের ভোগে দেবীকে দেওয়া হয় মাছের টক। মানুষের বিশ্বাস, মা গুহ্যকালী অতি জাগ্রত এবং শ্মশানবাসিনী। প্রতি রাতে তিনি শ্মশানে ঘুরে বেড়ান। তাই সন্ধ্যের পর মন্দির চত্বরে করোও প্রবেশ নিষেধ। আশ্বিন মাসে দেবীপক্ষের শুক্লা চতুর্দশী ও মাঘমাসে কৃষ্ণা রটন্তী তিথিতে দেবীর বিশেষ পূজা হয়।
Discussion about this post