প্রাচীন বট পাকুড়ে ঘেরা এক মন্দির। নিস্তব্ধতায় ঘেরা চারপাশ। এই চত্বরে দিনের বেলাতেও একা ঘুরলে ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠে শরীর। কথিত আছে, এই মন্দিরে শ্মশান কালী মায়ের পুজো দিয়ে অভিযানে বের হতেন দেবী চৌধুরানী। তাঁর সঙ্গী হতেন ভবানী পাঠক। সামনেই কালীপুজো। আর জলপাইগুড়ি জেলার গোশালা মোড়ের দেবী চৌধুরানী শ্মশানকালী মন্দিরের গল্প আপনাদের শোনাবো না, সেটা কিভাবে হয়! গা ছমছমে সেই সমস্ত জনশ্রুতি ও গল্পগাথার মধ্যেই দেবী চৌধুরাণীর শ্মশানকালী মন্দিরের পুজো আজও স্বমহিমায় হয়ে আসছে।
জানা যায়, দেবী চৌধুরাণীর একাধিক ডেরা ছিল। এটি তাদের মধ্যে অন্যতম। এও জানা যায়, জলপাইগুড়ি জেলার গোশালা মোড়ের কাছে এই শ্মশানকালী মন্দিরে বজরা করে পুজো দিতে আসতেন তিনি। বজরা করে এখানে এসে সুড়ঙ্গপথে সোজা মন্দিরে প্রবেশ করতেন। তারপর বের হতেন ডাকাতি করতে। আবার মন্দিরের গর্ভগৃহে এনেই রাখা হত লুঠ করে আনা সামগ্রী। চা বাগান ঘেরা ছোট্ট গ্রাম! গ্রামের একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে করোলা নদী! তারই পাশে প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো এই মন্দির। কথিত আছে এই মন্দিরের প্রথম পুরোহিত ছিলেন স্বয়ং ভবানী পাঠক। সেই আমলে নরবলিও হতো। তবে একবার ইংরেজ শাসকরা নরবলি দেওয়ার অপরাধে ভাবনী পাঠককে আটক করে। পরে তাঁর ফাঁসির সাজা হয়। এরপর থেকে নরবলি বন্ধ হয়ে গেলেও পশুবলি বন্ধ হয়নি। আজও এখানে সম্পূর্ণ তন্ত্র মতে পুজো হয়।
জানা যায়, দেবী চৌধুরাণীর শ্মশানকালী মন্দিরের অন্যতম বিশেষত্ব, মন্দিরের প্রধান সেবায়েত হলেন একজন মুসলমান৷ বংশপরম্পরায় ওই পরিবারের সদস্যরা, মন্দিরের নিত্যদিনের কাজ করেন৷ ফলে এই মন্দিরে যেমন হিন্দুরা পুজো দিতে আসেন, তেমনই স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনও দেবী মন্দিরে এসে প্রণাম করে যান। মন্দির অঙ্গনে নানা গাছ-গাছালি থাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মন্দির চত্বরে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে। গাছটি এতই বড় যে তার আসল মূলটি সহজে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।এছাড়া আছে একটি রুদ্রাক্ষ ফলের গাছ।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের দেবী চৌধুরানীর কাহিনির সঙ্গে এই মন্দিরটি যুক্ত।কথিত আছে, ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণীর গোপন আস্তানা ছিল এই মন্দিরে। ঘন জঙ্গল ও দুর্গম তিস্তার পাড়ে এই মন্দির ছিল ডাকাত রানির মূল ডেরা। সারা বছরই এই মন্দিরে নিষ্ঠা সহকারে পুজো হয়। তবে প্রতি অমাবস্যায় এখানে বিশেষ পুজো হয়। আর দীপান্বিতা অমাবস্যার কালীপুজোয় এখানে সারারাত ধরে পুজো হয়, পশুবলিও হয়। একটা সময় এখানে মাটির বিগ্রহ ছিল, বর্তমানে শ্মশানকালীর কষ্টিপাথরের মূর্তি বসানো হয়েছে। পূজারির কাছেই জানা গেল এই শ্মশানকালীর পুজোর আচার রীতি অন্যান্য কালীপুজোর থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে পুজো হয় সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে। মায়ের ভোগও হয় আমিষ পদ দিয়ে। শোল মাছ, বোয়াল মাছ-সহ অন্যান্য মাছের পদ নিবেদন করা হয় মা শ্মশানকালীকে। পাশাপাশি দেওয়া হয় মালসা ভোগও। এছাড়াও আশেপাশের অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনও তাঁদের নিজেদের রীতিনীতি অনুযায়ী মায়ের কাছে ভোগ নিবেদন করতে আসেন এখানে। কালীপুজোর রাতে এখানে উপচে পড়ে ভিড়। দূর-দূরান্ত থেকে বহু ভক্ত ছুটে আসেন ৩০০ বছরেরও বেশি পুরোনো দেবী চৌধুরাণীর শ্মশানকালী মন্দিরে।
Discussion about this post