বাংলাকে কালীক্ষেত্র বলা হয়। এর পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, বাংলার অলি-গলিতে একটা কালী মন্দির খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। এছাড়া বাংলার আনাচে কানাচে এমন সব কালী মন্দির বা কালীপুজো আছে, যার ইতিহাস অতি প্রাচীন বা খুবই সমৃদ্ধ। যেমন নদিয়া জেলার শান্তিপুরের চাঁদুনি বাড়ির কালীপুজো। এমনিতেই নদিয়া জেলা বৈষ্ণব ধর্মের বাড়বাড়ন্ত। স্বয়ং শ্রী চৈতন্যদেবের লীলাভূমি। সেখানে শাক্ত মতে কালীপুজো একটু অন্য রকম মাত্রা আনে বৈকি। অথচ দেখুন, এই নদিয়া জেলার তান্ত্রিক পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরেই এই বাংলার কালীমূর্তির সূচনা। যা ক্রমে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কথিত আছে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর গৃহশিক্ষক কাশীনাথ সার্বভৌম তাঁর বসত বাটিতে কালীপুজোর সূচনা করেছিলেন। যা কালক্রমে চাঁদুনি বাড়ির পুজো বলেই বিখ্যাত হয়ে যায়। চিরাচরিত নিয়ম ও প্রথা মেনে প্রায় সাড়ে পাচশো বছর ধরে পূজিতা হয়ে আসছেন নদীয়ার শান্তিপুরের চাঁদুনী বাড়ির চাদুনী মা কালী। কিন্তু এখানে মা কালীর নাম কেন চাঁদুনি হয়ে গেল? এর পিছনে রয়েছে এক মস্ত বড় ইতিহাস।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগেও নদিয়ার শান্তিপুর ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ৷ সেখানেই কাশীনাথ সার্বভৌম এবং গোপীনাথ সার্বভৌম নামে দুই ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁরা তন্ত্র সাধনা করতেন। কাশীনাথ ছিলেন বিবাহিত। তার স্ত্রী ও অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ। একদিন কাশীনাথ বাড়িতে নিত্য পুজোয় বসেছেন। এমন সময় তার কাছে আসে একটি বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটি তার কাছে এসে বলে তার খিদে পেয়েছে, তাকে প্রসাদ দিতে। তখন কাশীনাথ বলেন পুজো সম্পন্ন হয়নি। সে প্রসাদ এখন দিতে পারবে না। পুজো শেষে সে প্রসাদ নিয়ে বাইরে এসে দেখেন সেই মেয়েটি নেই। সেদিন রাতেই কাশীনাথের স্ত্রী স্বপ্ন দেখলেন সেই বাচ্চা মেয়েটিকে। বললে সে প্রসাদ চাওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্বামী তাঁকে প্রসাদ দেয়নি। এরপরই স্বপ্নেই দেবী তাঁর স্বরূপ দেখালেন কাশীনাথ সর্বভৌমের স্ত্রীকে। এবং তাঁকে সেই রূপেই মূর্তি গড়ে পুজো করলে তাঁদের অপরাধ ক্ষমা পাবে। পরদিনই মূর্তি গড়তে লেগে গেলেন কাশীনাথ সর্বভৌমের স্ত্রী। স্বপ্নে দেখা মায়ের রূপ অনুযায়ী মূর্তি গড়া যেদিন সম্পন্ন হল সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। তাই তিনি মায়ের নাম রাখলেন চাঁদুনি। পরের অমাবস্যায় চাঁদুনি মায়ের পুজো হল ঘটা করে। বাড়ির বড় বউ যেহেতু প্রথম মূর্তিটি গড়েছিলেন, তাই আজও চাঁদুনি মায়ের মূর্তিতে প্রথম মাটির প্রলেপ দেন বাড়ির বড় বউ বা মেয়ে।
নদিয়ার চাঁদুনি বাড়ির কালীপুজো নিয়ে আরও একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। সেটি হল, আজ থেকে প্রায় ২২ পুরুষ আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ গোপীনাথ সার্বভৌম একদিন বাড়ির নারায়ণ শিলার পুজোয় আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় একটি ছোট মেয়ে আসে। বাকি কাহিনীটা প্রায় একই। আদপে মেয়েটি আর কেউ নন, স্বয়ং মা কালী। গোপীনাথ তাঁর কাছেই স্বপ্নাদেশ পান এবং বাড়ির কাছেই পঞ্চমুণ্ডির আসনে ‘মা চাঁদুনী’ নামে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে দুই ভাই চাঁদুনি কালী মায়ের সাঘনা করে মহা তন্ত্রসাধক হয়ে ওঠেন। দেবীর নামেই শান্তিপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাড়িটির নাম ‘চাঁদুনীবাড়ি’ আর পাড়ার নাম ‘চাঁদুনীপাড়া’। প্রথা মেনে কালীপুজোর দিন সকালে সোনার গয়না পরানোর পরে বাড়ির ছেলেদের কাঁধে চড়ে দেবী, দুর্গাদালান থেকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে যান। যা পাটে ওঠা নামে পরিচিত। দুর্গা দালান এবং পঞ্চমুণ্ডির আসনে থাকে দুই প্রতিমা। ঘর চাঁদনি ও বাহির চাঁদনি। মন্দিরে প্রবেশের আগে দেবীকে শীতলভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। শীতলভোগে ভিজে মুগডাল, ডাবের জল, বেলের পানা, তরমুজ, শসা, ঠান্ডা দই-মিষ্টি ইত্যাদি দেওয়া হয়। চাঁদুনি মাকে দুটি মালা পরানো হয়, একটি লাল এবং একটি বেল গোলাপের। সোনার কামরাঙার মটরমালা থেকে শুরু করে সোনার শাঁখা বাঁধানো, নোয়া বাঁধানো, রতনচুড়, হাতপদ্ম, কোমরবন্ধনী, বাজুবন্ধ, পুষ্পহার, সীতাহার ইত্যাদি স্বর্ণালংকার এবং রৌপ্যালংকারে মাকে সাজানো হয়। দেবীর বুকে থাকে সোনার প্রজাপতি।
Discussion about this post