উচ্চ ঘরানার সাধক ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। তিনি ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি। এই বাংলার বুকে কালীচেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম কাণ্ডারি তাঁকেই বলা যায়। এককালে যেমন নদিয়ার সন্তান তন্ত্রিক পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ দক্ষিণাকালীর মূর্তি সৃষ্টি করে বাংলা তথা গোটা বিশ্বেই মা কালীকে নিয়ে এসেছিলেন গৃহকোনে। তেমনই মা কালীর প্রতি ভাবাবেগের বহিপ্রকাশের জন্য অপূর্ব সব শ্যামা সংগীত রচনা করে রামপ্রসাদ সেন সেই চেতনাকে প্রতিটি মানুষের অন্তরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। তিনিও শ্যামা সংগীতকে নিয়ে গিয়েছিলেন উচ্চমার্গে। আবার কাজী নজরুল ইসলামের অন্য ধারার শ্যামা সংগিত আজও কালীভক্তের গায়ে আজও কাঁটা দেয়। তবে রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত হোক বা কাজী নজরুল ইসলামের রচনা, পান্নালাল ভট্টাচার্যের ঐশ্বরিক কণ্ঠ ছাড়া বাঙালির শ্যামা আরাধনা সম্পূর্ণ হয় না। এ কথা হলফ করে বলাই যায়।
১৯৩০ সালে হাওড়ার বালিতে জন্ম হয়েছিল পান্নালাল ভট্টাচার্যের। ১১ ভাই বোনের মধ্যে সবথেকে ছোট ছিলেন তিনি। কিন্তু জন্ম থেকে কখনও বাবাকে দেখেননি। বাবা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মৃত্যুর জন্য মায়ের অবহেলা পেয়ে এসেছেন আজীবন। তবে শিশু পান্নালালের বাবার ভূমিকা পালন করেছিলেন দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আর মায়ের স্নেহ পেলেন মেজ বৌদিক কাছে। দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বাংলা আধুনিক গানের প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী। তাঁর হাত ধরেই গানের তালিম নিতে শুরু করেন পান্নালাল। তবে একটা কারণে তিনি দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকেও ছাপিয়ে যান। এই একবিংশ শতাব্দীর এই জেট যুগেও পান্নালাল ভট্টাচার্যের মধুর গলার শ্যামা সংগীত প্রতিটি কালীপুজোর মণ্ডপে বাজবেই। আজও তাঁর মধুর গলার কদর একফোঁটা কমেনি। কিন্তু এই পান্নালাল ভট্টাচার্যই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে নিয়েছিলেন এক মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত। অকাল বয়সে আচমকাই বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ। কেন তিনি এই আত্মহত্যা করলেন, তার পিছনে রয়েছে গভীর রহস্য।
দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আধুনিক গানের পাশাপাশি ভক্তিমূলক গানেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। পান্নালাল বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন। এক সন্তানও হয় তাঁর। কিন্তু তিনি ছিলেন আত্মভোলা। শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়াতেই তাঁর বেশি পছন্দের। এই বিষয়ে পান্নালালের পারিবারিক এক গল্প রয়েছে। দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য নাকি বহুবার মা ভবতারিণীকে দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও পান্নালাল কখনও তাঁর দর্শন পাননি। এই আক্ষেপ থেকেই তিনি শ্মশানে ঘুরে বেড়াতেন। সেই সময় অনেকেই তাঁকে দেখেছেন ‘মা’- মা’ বলে এদিক ওদিক ছুঁটে যেতে। জীবদ্দশায় মা কালী বা ভবতারিনীর খোঁজ না পাওয়ার আকুতিই হয়তো তাঁর শ্যামা সংগীতে ঝড়ে পড়ত। কমলাকান্ত রচিত‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিলো, সকলি ফুরায়ে যায় মা।
আবার রামপ্রসাদের লেখা, ‘জেনেছি জেনেছি তারা, তুমি জান ভোজের বাজি/যে তোমায় যে ভাবে ডাকে তাতেই তুমি হও মা রাজি’ গানে পান্নালালের কন্ঠে সেই আবেগের বহিপ্রকাশ পাওয়া গিয়েছে। পান্নালালের জীবনে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিনী যে কতখানি জায়গা দখল করেছিলেন তা জানা যায় সহশিল্পীদের কথায়। একবার পান্নালাল ভট্টাচার্যের সঙ্গে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র-সহ অনেক শিল্পী কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে দূরে কোথাও যাচ্ছিলেন স্টেজ শো করতে। ট্রেন যখন গঙ্গার উপর বালি ব্রিজ পার করছে, তখনই পান্নালাল অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। কারণ জানতে চাওয়ায় পান্নালাল বলেন, মা ভবতারিনীকে আজ তুঁতে রঙের বেনারসী পড়ানো হচ্ছে। সেই সময় অনেকেই তা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে ফেরের পথে পান্নালালকে নিয়ে নির্মলা মিশ্র এবং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় দক্ষিণেশ্বরে নেমে পড়েন। এরপর মন্দিরে গিয়ে তাঁরা সত্যিই অবাক, মা ভবতারিনীকে সত্যিই তুঁতে রঙের বেনারসি শাড়িতে সাজানো হয়েছে।
ধনঞ্জয় পুত্র দীপঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর কাকা পান্নালাল সম্পর্কে লিখেছেন, শেষদিকে পান্নালাল প্রায়ই উন্মাদের মতো শ্মশানে একা একা বসে থাকতেন। আর দেখা দে মা বলে হাহাকার করতেন। পান্নালালের এই হাহাকার ক্রমশ সীমা ছাড়িয়ে যায়। জানা যায়, তাঁর জীবনের এই অশান্ত সময়ে রামপ্রসাদের লেখা গান অপার সংসার নাহি পারাবার গানের রেকর্ডের জন্য রিহার্সাল দেওয়ার সময় দাদা ধনঞ্জয়ের কাছে বকা খেয়েছিলেন পান্নালাল। তাঁর কন্ঠে কালজয়ী এই গানেই ফুটে উঠল মাকে কাছে পাওয়ার আকুল মিনতি। এর মাত্র কয়েকদিন পর ১৯৬৬ সালের ২৬ মার্চ কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। মায়ের দর্শন পেতে যিনি আকুল হয়ে উঠেছিলেন, সেই মায়ের কোলেই ফিরে যান তিনি। থেমে যায় তাঁর মায়াবী কন্ঠ। কেউ কেউ বলেন, শেষ সময়ে নিশ্চই তাঁর মাতৃ দর্শন হয়েছে।
Discussion about this post