পশ্চিমবঙ্গের কোনও রুটেই নেই ‘কবচ’ প্রযুক্তি। সোমবার সকালে নিউ জলপাইগুড়ির কাছে রাঙাপানি স্টেশনের কাছে শিয়ালদাগামী ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে সজোরে ধাক্কা মারে একটি মালগাড়ি। সংঘর্ষের অভিঘাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনের দুটি কামরা উঠে যায় মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপর। রীতিমতো শূন্যে ঝুলতে থাকে একটি কামরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেই ছবি এবং ভিডিও। ফলে আবারও প্রশ্ন উঠছে, বছর দুই আগে ঘটা করে চালু করা দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষরোধী কবচ প্রযুক্তি কি এখানে ছিল না? তাহলে কোথায় চালু হয়েছে এই প্রযুক্তি?
সোমবার সকাল ৯টা নিউ জলপাইগুড়ির খুব কাছেই শিলচর থেকে আসা শিয়ালদাগামী ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারে একটি মালগাড়ি। দূর্ঘটনার অভিঘাত দেখে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মালগাড়ির গতিবেগ অনেকটাই বেশি ছিল। তা না হলে কাঞ্চনজঙ্ঘার এক্সপ্রেসের একটি কামরা এভাবে মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপর উঠে যেত না। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, কোথায় গেল ঘটা করে উদ্বোধন করা কবচ প্রযুক্তি? গত বছর, ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে একসাথে তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষ হয়েছিল। তখনই বলা হয়েছিল সারা দেশেই দ্রুত কবচ প্রযুক্তি চালু করা হবে। এক বছরের মধ্যে ফের আবারও দুটি ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। দূর্ঘটনার জন্য কে দায়ী, যান্ত্রিক বিভ্রাট না কি সিগনালিংয়ের গলদ, অথবা মানুষের ভুল, সেটা নিয়ে তদন্ত হবে। কিন্তু বারবার উঠে আসছে একটাই কথা, যদি কবচ প্রযুক্তি থাকতো, তবে এড়ানো যেত দূর্ঘটনা। তবে রেলবোর্ডের চেয়ারম্যান ও সিইও জয়া বর্মা সিনহা জানিয়ে দিয়েছেন, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই জোনে কবচ সিস্টেম ছিল না। এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক, এই কবচ প্রযুক্তি আসলে কি।
কবচ হল এমন একটি প্রযুক্তি, যার সাহায্যে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষ এড়ানো যায়। কবচ বা বর্ম, যাই বলা হোক না কেন, এই প্রযুক্তি অনেকগুলি যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশের মিলিত সিস্টেম। যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি বলে দাবি করে ভারতীয় রেল। ২০১২ সালে এই ধরণের প্রযুক্তির প্রথম ব্যবহার করেছিল রেল। তবে তখন নাম ছিল ট্রাফিক কলিশন অ্যাভোয়ডেন্স সিস্টেম বা টিসিএএস। পরে ওই প্রযুক্তি আরও উন্নত করে নাম দেওয়া হয় কবচ বা বর্ম। এই কবচ সিস্টেমে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি চিহ্নিতকরণ যন্ত্র একত্রে জুড়ে দেওয়া হয় ট্রেনের ইঞ্জিনে। পাশাপাশি রেলপথ, সিগনালিং ব্যবস্থার কন্ট্রোলের সঙ্গেও জুড়ে থাকে কবচ সিস্টেমের অন্যান্য যন্ত্র। এই সমস্ত যন্ত্র পরস্পরের সংকেত চিহ্নিত করে আদানপ্রদান করে। এবং এই প্রতিমুহুর্তে আদানপ্রদান হওয়া সংকেত পর্যালোচনা করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। যদি ওই রেলপথে বা ইঞ্জিনের সামনে কোনও বাঁধা আসে, সঙ্গে সঙ্গে ওই কবচ সিস্টেমের একটি উচ্চ তরঙ্গ বার্তা সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনের ব্রেক স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং চালককে বিপদসংকেত দেয়। ফলে সামনে চলে আসা কোনও ট্রেনের নির্দিষ্ট দূরত্বেই ইঞ্জিনটি দাঁড়িয়ে যায়।
কবচ প্রযুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট হল, এটি ট্রেনের গতি এবং রেলপথের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য ধারাবাহিকভাবে বিনিময় করে নিজেদের মধ্যে। ফলে কোনও ক্ষেত্রে চালক সিগনাল উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলে কবচ ট্রেনটিকে থামিয়ে দেবে। আবার ঘন কুঁয়াশা বা প্রচন্ড বৃষ্টিতেও চালক যদি সিগনাল ঠিকঠাক দেখতে না পান, তবে কবচ ধারাবাহিকভাবে চালককে সামনের সিগনাল সম্পর্কে জানিয়ে দেবে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে এরকমই একটি ইঞ্জিনে সওয়ার হয়েছিলেন স্বয়ং রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। তিনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখেন কবচ প্রযুক্তি দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ থামিয়ে দিতে আদৌ কতটা পারে। সেই ভিডিও তিনি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে শেয়ারও করেছিলেন। ইউরোপে বহু দেশেই এই ধরণের সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। ভারতে কবচ প্রযুক্তি তৈরি করেছে লখনউয়ের রিসার্চ ডিজাইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন বা আরডিএসও। এই কবচ প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করতে রেলমন্ত্রকের খরচ হচ্ছে প্রতি কিলোমিটার ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা। তবে সূত্রের খবর, এখন ভারতে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথ কবচের আওতায় রয়েছে। আর সম্প্রতি আরও ১০ হাজার কিলোমিটার রেলপথ কবচের আওতায় আনার জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছে।
Discussion about this post