আলোর উৎসব শেষ, তবুও দেখা নেই তাঁদের। আলোর মালায় সেজে উঠেছিল গোটা বাংলা, মণ্ডপে মণ্ডপে জমজমাট ভিড়ও ছিল। কিন্তু নেই তাঁরা। যাদের জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠতো সাধারণ মানুষের। আসলে বলতে চাইছি, কালীপুজো এল, কালীপুজো চলেও গেল। কিন্তু দেখা নেই শ্যামাপোকারদের। যেন কালীপুজোর আগাম খবর নিয়ে দলে দলে এসে ভিড় জমাতো শ্যামাপোকার ঝাঁক। আর কালীপুজোয় আলোর দাপাদাপি বাড়লে তাঁদের আর ধরে রাখা যেত না। তাঁরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতো সন্ধ্যা নামলেই। ঘরের টিউবলাইট হোক বা বাইরে লাগানো বাহারি আলো। আবার দোকানে দোকানে লাগানো জোরাল আলো বা খাবারের অস্থায়ী স্টলগুলির আলো। শ্যামাপোকাদের বাড়বাড়ন্তে আলো বন্ধ করে বসে থাকতে হতো অনেককে। কিন্তু বিগত কয়েকটি বছর ধরে এই চেনা ছবি অনেকটাই বদলে যাচ্ছিল। কালীপুজো এলেও শ্যামাপোকার ঝাঁক কমতে শুরু করেছিল। আর এ বছর তো কার্যত উধাও শ্যামাপোকা। বিষয়টি অনেকেরই নজরে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় টুকিটাকি আলোচনাও শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, আচমকা কোথায় গেল শ্যামাপোকার দল?
পতঙ্গ বিশেষজ্ঞদের দাবি, বল্গাহীণ দুষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে এমনিতেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক পতঙ্গ। শ্যামাপোকাও সেই দলে পড়েছে। ক্রমশ বিলুপ্তের পথে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী পোকা। পতঙ্গবিদদের একাংশের দাবি, এটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। তাঁদের আশঙ্কা, আগামীদিনে বড়সড় কোনও বিপদের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। পরিবেশবিদদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে আমাদের পরিবেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ঋতুচক্রের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রে। আর সে কারণেই অনেক প্রাণী বা পতঙ্গ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পরিবেশ থেকে। যা আগামীদিনে বিপদের ইঙ্গিত বহন করে আনছে।
মূলত দুর্গাপুজোর পর থেকেই একটু একটু করে দেখা মিলত শ্যামাপোকাদের। কালীপুজো আসতেই তাঁদের পরিমান বেড়ে যেত। বাড়ি থেকে রাস্তাঘাট, এমন কোনও আলো থাকত না, যার দখল নিত না শ্যামাপোকার ঝাঁক। ঘরে ও দোকান-বাজারে এই পোকার হাত থেকে রেহাই পেতে আলোগুলিতে গাছের ডাল ঝুলিয়ে রাখতে হত। আর রাস্তার আলোগুলো প্রায় মুখ ঢাকত শ্যামাপোকার দৌরাত্ম্যে। শ্যামাপোকা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই বাংলায়। কারণ হিসেবে উঠে আসছে এই বাংলায় কালীপুজোর বাড়বাড়ন্ত। পতঙ্গবিদদের দাবি, ঘণ সবুজ রঙের এই পোকার দৈর্ঘ্য তিন থেকে পাঁচ মিলিমিটার। এঁদের প্রজনন হয় আগস্ট মাসে। বৃদ্ধি হয় সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে। আর নভেম্বর এলেই এঁদের জীবনচক্র শেষ। যেখানে সবুজায়ন বেশি, বা যে জমিতে সবজি গাছ বা ধান চাষ হয় সেই চত্বরে এই পোকার প্রজনন বেশি হয়।
কিন্তু নগরায়ণের জেরে এখন কলকাতা বা আশেপাশের এলাকায় ধান চাষ আর হচ্ছে না। এটাও শ্যামাপোকা কম হওয়ার একটা কারণ। আবার জমিতে রাসায়নিক সার বা বেশি মাত্রায় কীটনাশক দেওয়ার ফলেও শ্যামাপোকার প্রজনন হচ্ছে না। পতঙ্গবিদদের একাংশ বাজির ক্ষতিকর রাসায়নিককেও দায়ী করছেন। কারণ, বাজি থেকে নির্গত সালফার গ্যাসের ধোঁয়া এই পোকার প্রজননে বাধা দেয়। আর শ্যামাপোকা নিখোঁজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আবহাওয়ার পরিবর্তন। এরা মূলত বর্ষাকালেই জন্মায় অর্থাৎ যখন বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে এখন বর্ষাকাল সময়ে হয় না। খামখেয়ালী বৃষ্টিপাতের জন্যও শ্যামাপোকার মতো পতঙ্গ জন্মাতেই পারে না। এই সমস্ত সমস্যার জেরেই কালীপুজোর সময় অতি পরিচিত চিত্র যেন হারিয়ে গিয়েছে আচমকা। হারিয়ে গিয়েছে শ্যামাপোকারা। যা শহরের পরিবেশে বিপর্যয় ঘটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
Discussion about this post