মেঘালয়ের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়। সেখানেই রয়েছে অতি প্রাচীন এক মন্দির। যেটি দেখতে অতি সাধারণ হলে কি হবে, এই মন্দিরের পিছনে কাহিনী ও জনশ্রুতি অসাধারণ। সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম এই মন্দির ঘিরে রয়েছে অজস্র জনশ্রুতি। মন্দিরটি নার্তিয়াং দূর্গা মন্দির নামে পরিচিত, স্থানীয়রা এই মন্দিরকে জয়ন্তেশ্বরী মন্দির বলেও চেনেন।
পুরাণ অনুযায়ী জয়ন্তিয়া পাহাড়ের নর্তিয়াং গ্রামে দেবী সতীর বাম উরু পড়েছিল। এখানেই গড়ে উঠেছে অতি প্রাচীন মন্দির। কথিত আছে মন্দিরটি নির্মান করিয়েছিলেন জয়ন্তিয়ার রাজা জাসো মানিক, তাঁর রাজত্বকাল ১৬০৬ থেকে ১৬৪১ সাল। জয়ন্তিয়ার রাজা জাসো মানিক কোচবিহারের রাজা নর নারায়ণের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তার পর থেকেই সেখানে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বিস্তার হয়েছিল। নার্তিয়াং দূর্গা মন্দিরটিও সেই সময়কার বলে মনে করা হয়। মন্দিরটি প্রায় ৬০০ বছরের বেশি পুরোনো। আর সনাতনী শাক্ত মতাবলম্বীদের কাছে এই মন্দির অতি পবিত্র। স্থানীয়দের মতোই অনেকে বিশ্বাস করেন, এই মন্দিরই মা দূর্গার স্থায়ী আবাসস্থল। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ের নর্তিয়াং মন্দিরে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় প্রতিবছর। দেশ বিদেশ থেকেও প্রচুর ভক্ত আসেন এই মন্দিরে। শাক্তমতেই এখানে মা দূর্গার পুজো হয়। মায়ের সঙ্গে ভৈরব হিসেবে এথানে থাকেন মহাদেব কামাদিশ্বর।
পুরাণমতে বিষ্ণুর সুদর্শণ চক্রের আঘাতে সতীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে মর্ত্যের বিভিন্ন প্রান্তে পড়েছিল। ওই ৫১টি খণ্ডই সতীর ৫১ পীঠ হিসেবে খ্যাত। দাবি, মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ের নার্তিয়াং গ্রামে দেবী সতীর বাম উরু পড়েছিল। তাই এই মন্দির সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম। কোচবিহারের রাজা ধন মাণিক একসময় মেঘালয়ের এই অংশে তাঁর গ্রীষ্ণকালীন রাজধানী তৈরি করেন। জনশ্রুতি, এক রাতে তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। স্বয়ং দেবীই তাঁকে নার্তিয়াং গ্রামের স্থান মাহাত্ম্য জানিয়েছিলেন। রাজা ধন মাণিক এরপরই নার্তিয়াংয়ের দূর্গামন্দির বা জয়ন্তেশ্বরী মন্দির নির্মান করান। জানা যায় একসময় এটি জয়ন্তিয়া দূর্গের অংশ ছিল। কালের নিয়মে যা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময় স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ এই মন্দিরের পুনর্নিমান করিয়েছে।
এখানে প্রচলিত আচার বা পূজা পদ্ধতিতে মা দূর্গার আরাধনা হয় না। মেঘালয়ের জনজাতির প্রথাও এখানকার পুজোয় যুক্ত হয়ে গিয়েছে। প্রাচীন হিন্দু এবং খাসি সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠানের মিশ্রণে নার্তিয়াং দূর্গা মন্দিরে পুজো হয়। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হলেন স্থানীয় খাসি সর্দার বা সাইয়েম। বর্তমানে এথানে দূর্গাপুজোর সময় পাঁঠাবলি হয়। কিন্তু এককালে এখানে নরবলির প্রচলন ছিল। স্থানীয়দের দাবি, প্রাচীন এই মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি গোপন সুরঙ্গ রয়েছে। যা গিয়ে সোজা নীচের মিন্টডু নদীতে মিশেছে। বলির পর মুণ্ডটি সেই সুরঙ্গ দিয়ে গড়িয়ে দেওয়া হতো। সবচেয়ে আশ্চর্ষের সারা বছর দূর্গামূর্তিতে পুজো হলেও দূর্গাপুজোর সময় একটি কলাগাছকে সাজিয়ে পুজোর রীতি পালিত হয়। আর পুজোর শেষে তা স্থায়ীন মিন্টডু নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের দিন দেবী দূর্গাকে গান স্যালুট দেওয়ার প্রাচীন রীতিও রয়েছে। যা দেখতে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। আর মন্দিরের পুরোহিত বা সাইয়েমরা বিগত ১৭ প্রজন্ম ধরে এখানে পুজো করে আসছেন।
Discussion about this post