২০১১ সালে রাজ্যে ঐতিহাসিক পালাবদল হয়েছিল। পতন হয়েছিল ৩৪ বছরের বামজমানার, রাজ্যের ক্ষমতা এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে। সেই থেকে এক দশকের বেশি সময় হয়ে গেল, বামফ্রন্টের পতন আরও হয়েছে। এখন কার্যত শূন্যে অবস্থান করছে তাঁরা। ২০১১ সালের পর রাজ্যে সংগঠিত হয়েছে একের পর এক নির্বাচন। কোনও নির্বাচনেই সাফল্য ধরা দেয়নি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের। কিন্তু সম্প্রতি আর জি কর ইস্যুতে আড়াল থেকে আন্দোলন গড়ে তুলে সিপিএম কিছুটা হলেও রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছিল। এলাকায় এলাকায় ছোট ছোট প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন, যুব সংগঠনের হাতে রাশ তুলে দেওয়া, প্রভৃতির মাধ্যমে সিপিএম কিছুটা হলেও সংগঠন চাঙ্গা করতে শুরু করেছিল। ঠিক সেই সময়ই গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো তন্ময় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে উঠল মহিলা সাংবাদিককে হেনস্থার অভিযোগ। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখল আলিমুদ্দিন। সাত পাঁচ না ভেবে তড়িঘড়ি তন্ময় ভট্টাচার্যকে সাসপেন্ড করল দল। এরপর চলবে আভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রক্রিয়া। সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, তাঁর বক্তব্য না শুনে, অভিযোগের সারবত্তা বিচার না করেই কেন তাঁকে সাসপেন্ড করল দল? এখানেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এটা করে কি তাঁরা নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারবে?
সাম্প্রতিক অতীতে সিপিএমের অন্দরে কিছুটা বদল পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন, দলের নেতৃত্বে মহম্মদ সেলিমের মতো স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাকে সামনে আনা হয়েছে। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, দীপ্সিতা ধর, প্রতীক উর রহমানের মতো নবীন প্রজন্মের নেতৃত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশের বক্তব্য, এতকিছুর পরও আর জি কর কাণ্ড নিয়ে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ তৈরি হয়েছে, তার খুব একটা ফায়দা তুলতে ব্যর্থ হয়েছে সিপিএম। উল্টে যেখানে আর জি কর কাণ্ডে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে যখন গণ আন্দোলন হচ্ছে, সেখানে তন্ময় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে উঠল মহিলা সাংবাদিককে যৌন হেনস্থার অভিযোগ। যা নিয়ে স্পষ্টতই বিব্রত লাল পার্টি। যা নিয়ে প্রাক্ সম্মেলন পর্বে সিপিএমের মধ্যে নতুন করে ‘উত্তেজনা’ তৈরি হয়েছে সিপিএমের অন্দরে। তারই অঙ্গ হিসেবে তন্ময় ভট্টাচার্যকে তড়িঘড়ি সাসপেন্ড করা বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ।
রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, সারা বিশ্বেই কার্যত কমিউনিজম উঠে গিয়েছে। চিন বা ভিয়েতনামের মতো তথাকথিত কমিউনিস্ট দেশও আজ কমিউনিজম থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছে। সেখানে ভারতের বামপন্থীরা এখনও সেই আদ্যিকালের আদর্শ এবং কাঠামো আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। তাই অনেকে মনে করছেন, আলিমু্দ্দিন স্ট্রিটের মাথারা কার্যত ইতিহাসের সঙ্গেই লড়াই করে চলেছেন। তাই যে কোনও খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার পথ খুঁজছেন। অপরদিকে সিপিএম থেকে সাসপেন্ড হওয়া নেতা তন্ময় ভট্টাচার্যের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়েছে। তবুও তাঁর কোনও কথা না শুনেই তাঁকে সাসপেন্ড করেছে দল। তিনি আরও বড় প্রশ্ন তুলেছেন, আগামীদিনে যদি এরকম আরও অভিযোগ ওঠে তাহলেও কি সিপিএম তাঁদেরকে সাসপেন্ড করতে থাকবে? এরকম চলতে থাকলে তো দলই উঠে যাবে।
সিপিএমের একটা বড় অংশ মনে করছে, অভিযুক্ত এবং দোষী এক নয়। ফলে এক মহিলা সাংবাদিক একটা অভিযোগ করলেন, আর তড়িঘড়ি অভিযুক্তকে কাঠগড়ায় তুলে দেওয়া হল, এটা ঠিক না। কিন্তু সিপিএমের একাংশের মতে, এই সঙ্কটজনক সময়ে পেশাগত কাজ করতে গিয়ে এক তরুণী হেনস্থা হওয়ার অভিযোগ সিপিএম বাড়তি ‘গুরুত্ব’ দিতে চেয়েছে। দলের অনেক নেতা-কর্মীরাই তন্ময় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। ফলে নেতৃত্ব আর ঝুঁকি নিতে চাননি। অপরদিকে, তন্ময় ভট্টাচার্যকে আর জি করের নির্যাতিতার সুবিচার চেয়ে আন্দোলনে অনেকটাই সামনের সারিতে দেখা গিয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধেই উঠেছে অভিযোগ, তাই তড়িঘড়ি সাসপেন্ড করে দল বোঝাতে চেয়েছে তাঁরা কোনও অন্যায় বরদাস্ত করে না। এবার তন্ময়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করবে দলের ‘ইন্টারনাল কমপ্লেন কমিটি’। সেখানে যদি প্রমাণিত হয় তন্ময়ের বিরুদ্ধে সত্যিই চক্রান্ত হয়েছিল, তাহলে সিপিএম পাল্টা প্রচারের সুবিধা নেবে। নচেৎ সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একপ্রকার শাস্তি তো দিয়েই রাখা হল। অর্থাৎ সাপও মরল, লাঠিও ভাঙলো না।
Discussion about this post