সেই ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু, এরপর ধাপে ধাপে অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পথ চলা অতি দীর্ঘ। তাঁর জীবনে এসেছে অনেক উত্থান-পতন। বদলেছে জীবনের চালচিত্র, বদলায়নি একটিই জিনিস। সেটা হল তাঁর বাসস্থান। পাম অ্যাভিনিউয়ের সরকারি আবাসনের দুই কামরার এক চিলতে ফ্ল্যাট। সেখানেই আজীবন থেকে গেলেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই ফ্ল্যাটই ছিল একমাত্র ঠিকানা। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অনেক বড় সরকারি বাড়ি বা বাংলো তিনি পেতে পারতেন। এমনকি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই পেতে পারতেন আরও ভালো বাসস্থান। কিন্তু তিনি কোনওটাই বাছেননি, একমাত্র পাম অ্যাভিনিউয়ের ওই ফ্লাটই ছিল তাঁর একমাত্র পছন্দ।
কিন্তু কেন তিনি এই ফ্ল্যাট ছাড়তে চাইতেন না? এই নিয়ে তাঁকে বহুবার প্রশ্ন করা হয়েছে। প্রতিবারই তিনি একটিই কথা বলেছিলেন। সেটা হল, বড় কোনও সাজানো গোছানো ঘরে গেলে আমার অস্বস্তি হবে। এই জবাবে তাঁর বামপন্থী মানসিকতার স্পষ্ট পরিচয়। তখন ভরা বাম জমানা। বাম নেতাদের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। জেলায় জেলায় বহু বাম নেতা-কর্মীদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকেন দু-কামরার এক ফ্ল্যাটে। যা নিয়ে বামফ্রন্টের অন্দরেও অনেকে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধবাবু কোনও দিনও সে সব আপত্তি কানে তোলেননি। জানা যায়, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব নাকি একবার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন গড়িয়াহাটে আবাসন দফতরের একটি বড় বাড়িতে উঠে আসতে। কিন্তু গৌতম দেবের সেই প্রস্তাব শোনামাত্রই নাকচ করে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এমনকি বেশ কড়া সুরে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে আর কোনও দিনও যেন তাঁকে এই বিষয়ে জোর করা না হয়।
একবার এক সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন কেন তিনি পাম অ্যাভিনিউয়ের ওই ছোট্ট ফ্লাটটি ছাড়তে চান না। তাঁর কথায়, কলেজে যে ধরণের পোশাক পড়তাম, যা খেতাম, যে ভাবে আড্ডা দিতাম, এখনও তাই করি। এটাই আমার সামাজিক স্তর। তাই বড় কোনও ঘরে সাজানো গোছানো বেডরুমে থাকতে আমার অস্বস্তি হবে। তিনি কেন এই কথা বলেছিলেন, সেটা যারা তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন তাঁরা বুঝবেন। গোটা একটা ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে চে গেভারা, লেলিন থেকে গার্সিয়া। আরও কত বইয়ের সম্ভার তাঁর ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটজুড়ে। আছে অনেক ছবি। তাই তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার বই, পড়ার টেবিল ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না। অসুবিধা হবে। এটাই আমার স্বাধিনতা। বই পাগল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজের জগতে এতটাই মগ্ন থাকতেন যে একবার তাঁর ফ্ল্যাটের বাথরুমের দেওয়াল ফাটিয়ে বটগাছ গজিয়ে বড় হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেদিকে ধ্যানই দেননি। পরে তৎকালীন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজে উদ্যোগ নিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন। আবার ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাম অ্যাভিনিউয়ের সেই ফ্ল্যাট সংস্কার করিয়েছিলেন। আজ ৮ আগস্ট সেই প্রিয় ফ্ল্যাট থেকেই চিরবিদায় নিলেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
Discussion about this post