বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “গাধা গুলিয়ে জল খায়”। বর্তমান রাজ্য প্রশাসনের অবস্থা ঠিক সেরকমই। যে দাবি মানতেই হল, সেই সিদ্ধান্ত কিন্তু অনেক আগেই নেওয়া যেত। যেখানে আন্দোলনরত জুনিয়ার ডাক্তাররা এই একই দাবি করে আসছিলেন। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের অপসারণ, স্বাস্থ্য ভবনের জোড়া কর্তার অপসারণ। এর জন্য প্রায় একমাসের বেশি সময় অপেক্ষা করা কেন? যদি সদিচ্ছাই থাকে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী একটি সদর্থক বার্তা দিতেই পারতেন। কিন্তু এমন সময় তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। জুনিয়র ডাক্তাররা, নাগরিক সমাজ, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সমস্বরে দাবি করছেন, চাপের মুখে নতি স্বীকার করলেন মুখ্যমন্ত্রী। এটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমানায় সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে তুলে ধরছে ওয়াকিবহাল মহল।
এই ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু যে ব্যাপারটি তর্কের অতীত, তা হল এই আর জি কর কাণ্ড একইসঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের দুটি দফতরের দুর্নীতি সামনে এনে দিল। যা কার্যত নজিরবিহীন। তৃণমূল কংগ্রেসের ১৩ বছরের জমানায় বেশ কয়েকটি দুর্নীতি সামনে এসেছে, সবকটিরই তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি। যেমন শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলি ছিল আলাদা আলাদা অভিযোগের ভিত্তিতে। বর্তমানে আর জি কর হাসপাতালের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা অন্য এক দিগন্ত উন্মোচিত করল। বেআব্রু করল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের গাফিলতি, স্বাস্থ্য দফতরের দুর্নীতি। হাসপাতালে কর্মরত এক মহিলা তরুণী চিকিৎসক ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটির পর সামান্য বিশ্রাম নিতে গিয়েছিলেন এই ভেবে, যে তিনি সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন। কিন্তু হতভাগ্য মেয়েটি জানতো না এখানেই পাতা হয়েছে ফাঁদ। এই মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন, প্রতিটি সুরানিতেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছেন। একটি খুনের ঘটনাকে প্রথমে আত্মহত্যা বলার চেষ্টা হল, এরপর অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলার রুজু হল, শেষ পর্যন্ত জানা যাচ্ছে, ঘটনাস্থলের চরিত্রই বদল করা হয়েছে, তথ্য প্রমান লোপাট করা হয়েছে। এই অভিযোগ তুলছে স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট। যা যেকোনো রাজ্য সরকার বা পুলিশ প্রশাসনের ক্ষেত্রে চরম অবমাননাকর। অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতর। তাহলে এই ব্যর্থতার দায় তাঁর হবে না কেন? এই প্রশ্নটাই এখন তুলছে রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক মহল।
একটা মৃত্যু, তাও আবার রাজ্যের এক প্রথম শাড়ির সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এক কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তারের মৃত্যু, যিনি গিয়েছিলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। এমবিবিএস পাশ করার পর আরও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতেই তাঁর আর জি কর হাসপাতালে যাওয়া। কিন্তু সেখানেই ঘটে গেল অঘটন, ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর, সেই তরুণী চিকিৎসকের দেহ পাওয়া গেল আর জি কর হাসপাতালের এক সেমিনার হলে। একটা হাসপাতালেই মৃত্যু, ক্ষতবিক্ষত দেহ, তাও ১৪ ঘণ্টা লেগে গেল এফআইআরদের করতে। প্রথমে আত্মহত্যা তারপরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর দাবি। এও কী সম্ভব? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী করছিল? কেন তারা দেহ পরীক্ষা করে খুনের তত্ত্ব সামনে আনলেন না, যেখানে প্রফেশনাল চিকিৎসকদের অভাব নেই ! এখানেই প্রশ্ন উঠছে, কিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। অপরদিকে ওই হতভাগ্য মেয়েটির বাবা-মা, তাদের পায়ে তিন ঘন্টার বেশি বসিয়ে রাখা হয়েছিল অন্য জায়গায়। কেন, কী উদ্দেশ্যে সাধনে? তবে কি সত্যিই কিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল? ধামাচাপা যে দেওয়া হচ্ছিল, প্রমাণ যে লোপাট করা হয়েছে, তা এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। কলকাতা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট, প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং শীর্ষ আদালতগুলি। যার উত্তর এখনও দিতে পারেনি রাজ্য প্রশাসন। অপরদিকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে আরজিকর যে থানার আওতাধীন, সেই তালা থানার ওসিকে। সিবিআই গ্রেফতার করেছে সেই সময় আরজি কর হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে। দুই আর দুইয়ে মিললে হয় চার। পুলিশ এবং প্রশাসন মিলিতভাবে এক গভীর ষড়যন্ত্র তৈরি করেছিল। সিবিআই যাকে বলছে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র। কিন্তু কেন এই ষড়যন্ত্র? কেন এই ষড়যন্ত্র রচনা হল? যার উত্তর খুঁজে সিবিআই। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে সিবিআইয়ের দায়ের করা স্ট্যাটাস রিপোর্ট পড়ে প্রধান বিচারপতি তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ যথেষ্টই বিচলিত। তারা সরাসরি বলেছেন এই রিপোর্ট যথেষ্ট উদ্ভিদজনক, এবং আমাদের বিচলিত করছে। তাহলে এর অর্থ ধরে নেওয়াই যায়, সিবিআই এমন কিছু পেয়েছে যার সত্যিই খুব উদ্বেগজনক। তাহলে কি আরো বড় কোনও মাথা এই ধর্ষণও খুনের মামলায় জড়িত? আপাতত টালা থানার ওসি গ্রেফতার, এরপর কি সিবিআই আরও উপরমহল পর্যন্ত যাবে? তড়িঘড়ি সারানো হল কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। সরানো হয়েছে ডিসি নর্থ অভিষেক গুপ্তকেও। প্রাক্তন পুলিশ কর্তারা বারবার দাবি করছেন, একজন ওসি এই ধরনের সাহস দেখাতে পারবেন না, যে ক্রাইম সিন পরিবর্তন করা হবে, তথ্য ও প্রমাণ লোপাট করা হবে। ওপর মহলের নির্দেশ ছাড়া ওসি এই কাজ করতেই পারে না। সিবিআই রিপোর্টে এমনই কিছু ছিল, যা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় উল্লেখ করেছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী করছিল? অর্থাৎ তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, বা অন্যান্য আধিকারিকরা? জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন কিন্তু এই দিকটাই নির্দেশ করছিল। সন্দীপ ঘোষ এবং তাঁর অনুগামীরা, যারা গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা, শিক্ষা অধিকর্তা-সহ কয়েকজনের বদলি। রাজ্য সরকার একে একে সেই সব দাবি মেনে নিল। কিন্তু তার জন্য প্রায় একমাস অপেক্ষা করতে হল দুনিয়ার ডাক্তারদের। কেন? তাহলে কি মুখ্যমন্ত্রী সবই জানতেন? কারণ তিনিই তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী? জুনিয়ার ডাক্তারদের আরও একটি দাবি ছিল, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের অপসারণ। মুখ্যমন্ত্রী তাও মেনে নিলেন। যদিও আগের দিন বলেছিলেন, সিপি পদত্যাগ করতে চায়। যা তিনি সন্দীপ ঘোষকে নিয়েও বলেছিলেন। দুটো ক্ষেত্রেই একটা অদ্ভুত মিল। একদিকে সন্দীপ ঘোষ, যার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ, অন্যদিকে বিনীত গোয়েল, তাঁর বিরুদ্ধেও বিস্তার অভিযোগ। দুজনই সরলেন, কিন্তু সময় মতো নয়। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দুজনকেই অন্যত্র সরানো হয়েছিল। আমরা বলছি না স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলছেন। শুনুন…
বাইট – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী (কালীঘাটে বৈঠকের পর)
এর আগে মুখ্যমন্ত্রী সল্টলেকে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্ণামঞ্চে যান। সেখানে তিনি দাবি করেন, সব ফাইল তার কাছে আসে না। তিনি সবকিছু জানতে পারেন না।
বাইট – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী (সল্টলেকে ধর্ণামঞ্চে)
ঘুরপথে বলতে গেলে তিনি কোনও দায় নিতে রাজি নন। এখানেই উঠছে প্রশ্ন, তবে কি মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি তার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করছেন? যে কাজটা একমাস আগেই করা যেত, সেটাই করলেন ৩৫ দিন পর। তার অধীনেই রয়েছে স্বাস্থ্য ও পুলিশ দফতর। তাহলে কি তার ব্যর্থতাও এখানে সামনে আসছে না? ১৪ই আগস্ট রাতেই, আর জি কর হাসপাতালে হামলার পর, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন, সিপি কলকাতাকে আমি নির্দেশ দিয়েছি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে। আজ সেই সিপিকেই সরে যেতে হল। ব্যর্থতাটা কার? প্রথমে শিক্ষা, তারপর খাদ্য, এবার স্বাস্থ্য, সঙ্গে স্বরাষ্ট্রও যুক্ত হচ্ছে। প্রতিটির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার কী হবে?
Discussion about this post