গত ৯ আগস্ট সকালে কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারতলার সেমিনার হলে উদ্ধার হয় কর্তব্যরত এক মহিলা চিকিৎসকের দেহ। অভিযোগ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং কলকাতা পুলিশ প্রথম দিকে এটাকে আত্মহত্যা অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে দেখিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এই অভিযোগেই আর জি কর হাসপাতাল উত্তাল হয়ে ওঠে। আশ্চর্যজনকভাবে পুরো বিষয়টি অযথা জটিল করে তোলে রাজ্য প্রশাসন। কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ উঠলেও নবান্ন কোনও পদক্ষেপ বা কড়া নির্দেশ দেয়নি। আর জি করের তৎকালীন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এলেও মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে অন্যত্র বদলি করে দায় সেরেছিলেন। সবমিলিয়ে আর জি কর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এবং কর্ম বিরতি ছড়িয়ে পড়ল গোটা রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে। যা ঘটনার ২৪ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও অব্যাহত।
৯ আগস্ট, ২০২৪
আর জি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এর স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। তারপরও কলকাতা পুলিশের টালা থানার আধিকারিক অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে। ঘটনা পরম্পরার সময় বা টাইমলাইন নিয়েও রয়েছে প্রশ্নচিহ্ন। আর জি করে নির্যাতিতার বাবা-মা ঘটনার চার দিনের মাথায় কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কলকাতা পুলিশের ওপর আস্থা না রাখতে পেরেই তাঁরা সিবিআই তদন্তের দাবি জানান। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ নজিরবিহীনভাবে একদিনের শুনানিতেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দেয়। এমনকি কয়েকদিন পরই দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আর জি কর মামলা শুনতে চায়। এবং সেই শুনানিতেও কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।
১০ আগস্ট, ২০২৪
১০ আগস্ট অর্থাৎ ঘটনার পরদিনই কলকাতা পুলিশ অকুস্থল অর্থাৎ সেমিনার হলের পাশে একটি ছেঁড়া হেডফোনের অংশ এবং সিসিটিভি ফুটেজের সূত্র ধরে চিকিৎসক ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় একজনকে গ্রেফতার করেছিল। ধৃতের নাম সঞ্জয় রায়, তিনি কলকাতা পুলিশের কর্মরত একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। কিন্তু তাঁর পরিচয় নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে চরম অসস্তিতে পড়েন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। আর জি কর চিকিৎসক খুনের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ওই একজনই গ্রেফতার। সিবিআই তদন্তভার হাতে নেওয়ার পর কেটেছে প্রায় তিন সপ্তাহ। তবুও নেই কোনও বড় আপডেট। বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, ঘটনাস্থলের প্রমান লোপাটের জেরেই সিবিআই তদন্ত ধীর গতিতে চলছে। যদিও এই বিষয়ে সিবিআই এখনও পর্যন্ত মুখ খোলেনি। তবে আর জি করে দুর্নীতি সংক্রান্ত এক পৃথক মামলার তদন্তভারও সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ-সহ চারজন।
২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সন্দীপ ঘোষ. যিনি আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রায় স্থায়ী অধ্যক্ষ হিসেবে নিজের নাম নথিভূক্ত করে ফেলেছিলেন। অভিযোগ, অত্যন্ত শাসক ঘনিষ্ট এই চিকিৎসক-প্রাশাসক কয়েকবার বদলি হলেও কোনও এক ইন্দ্রজালে কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসতেন সেই আর জি করে। এমনকি মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর তিনি চাপে ইস্তফা দিলেও কয়েকঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে বদলি করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। ফলে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে আর কোনও সন্দেহ নেই। সিবিআই এহেন সন্দীপ ঘোষকে টানা ১৫ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাঁর বাড়ি, হাসপাতালে তাঁর চেম্বার-সহ একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে। একসময় মনে হচ্চিল সল্টলেক সিজিও কমপ্লেক্সই তাঁর অফিস হয়ে উঠেছে। রোজই নিয়ম করে সেখানে যান এবং ১০-১২ ঘণ্টা থাকার পর রাতে বাড়ি ফেরেন। অবশেষে দুর্নীতি মামলায় ১৬তম দিনে তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই। কিন্তু খুন এবং ধর্ষণ ঘটনায় এখনও আতান্তরে সিবিআই গোয়েন্দারা। জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন চলছে, নাগরিক সমাজও নিয়ম করে প্রতিবাদ কর্মসূচি, মিছিল করছেন। মহিলারা রাত দখল কর্মসূচি পালন করছেন। ধর্ষকের ফাঁসির দাবি, মহিলাদের নিরাপত্তার দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি এবার কলকাতা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে জেলায় জেলায়। চাপে থাকা শাসকদল বিধানসভায় নতুন করে কড়া আইন আনার জন্য বিল পাশ করিয়েছে। তবুও নিভছে না বিদ্রোহের আগুন, সুবিচারের দাবি থেকে স্লোগান সরেছে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগে। রাজ্যের প্রথমসারির মেডিকেলে কর্তব্যরত এক মহিলা চিকিৎসকের নারকীয় মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা সমাজকে। তাই এখন দেখার সুবিচার কোন পথে আসে।
Discussion about this post