দুর্গাপুজোর আর মাত্র কয়েকটা দিন। দেখতে দেখতে মহালয়া চলে গেল। কলকাতায় বহু মণ্ডপে পুজোর উদ্বোধন শুরু হয়ে গিয়েছে। আর শহরতলি বা জেলায় জেলায় মণ্ডপ তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। মা আসছেন বছর পর। কলকাতার কুমারটুলি হোক বা জেলায় জেলায় কুমোরপাড়া, প্রতিমাশিল্পীদের শেষ মুহূর্তে তুলির টান চলছে। কিন্তু আপনি কি জানেন, দূর্গা প্রতিমা গড়তে পতিতালয়ের মাটি লাগবেই? পতিতালয় বা যৌনপল্লির মাটি ছাড়া দূর্গা মূর্তি তৈরি হয় না। এটা শাস্ত্রেই বলা আছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক এর পিছনে হৃদয় বিদারক সেই কারণ।
আমরা জানি, কয়েক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় পুত্র-কন্যা সহ মা দুর্গার মূর্তি তৈরির কাজ। প্রথমে কাঠামো তৈরি, এরপর তাতে খড় বাঁধা হয়। সেই খড়ের গায়ে মাটি লেপে, তার উপর রং করে একটু একটু করে ফুটিয়ে তোলা হয় দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি। নদী পাড়ের নরম কাদা মাটি মূর্তি তৈরির জন্য আদর্শ। কিন্তু শুধু সেই মাটিই যথেষ্ট নয় দূর্গা মূর্তির ক্ষেত্রে। শাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরির সময় চারটি জিনিস অপরিহার্য। এই চারটি জিনিস হল – গঙ্গামাটি, গোবর, গোমূত্র এবং নিষিদ্ধপল্লীর মাটি। কিন্তু নিষিদ্ধপল্লীর মাটি কেন?
এর পিছনে যেমন পৌরাণিক কাহিনী আছে, তেমনই শাস্ত্র সম্মত কারণও আছে। পুরাণ অনুযায়ী একবার ঋষি বিশ্বামিত্র যখন ইন্দ্রত্ব লাভের জন্য কঠোর তপস্যা করছিলেন, তখন তাঁর ধ্যান ভাঙাতে উঠেপড়ে লাগেন দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি স্বর্গের অপ্সরা মেনকাকে ঋষির ধ্যানভঙ্গের জন্য পাঠান। অপ্সরার নাচে বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভেঙে যায়। যে কাজ স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র পারেননি, সেই কাজ অতি সহজেই করেছিলেন মেনকা। হোক না তিনি স্বর্গের অপ্সরা, তবু মেনকা তো আর সতী রমণীর পর্যায়ে পড়েন না।
আর শাস্ত্রের ব্যাখ্যা হল, অকালে মহামায়া মোট ৯টি রূপে পূজিতা হন। যারা নবকন্যা নামে পরিচিত। দুর্গার এই নয় রূপ হল – নটী, ধোপানি, ব্রাহ্মণী, শুদ্রানী, গোয়ালিনী, কাপালিনি, নাপিতানি, মালিনী ও পতিতা। অর্থাৎ ভগবতী মহামায়া সমাজের সকল স্তরের মহিলাদের প্রতিনিধি স্বরূপ। ফলে দূর্গা মূর্তি তৈরি করতে পতিতালয়ের মাটি অবশ্যই লাগে।
আবার প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, পতিতাপল্লি মানেই অশুদ্ধ জায়গা। সেখানে প্রতি রাতে চলে ‘বেলেল্লাপনা’। পতিতালয়ে গিয়ে বাবুরা তাদের এক রাতের রক্ষিতা খুঁজে পান। তারপর কোনও একটা ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ। আর তারপর যা হয়, তা তো কহতব্য নয়। বিদ্বজনরা বলছেন, পুরুষেরা পতিতার বাড়ি গিয়ে যৌনখেলায় মাতে। আর ঠিক সেই কারণেই সে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত পুণ্য সেখানে ফেলে আসে। বদলে সেখান থেকে নিয়ে আসে ঘড়া ভরতি পাপ। তাই বহু পুরুষের পুণ্যে পতিতালয়ের মাটি পরিপূর্ণ। শাস্ত্রে তেমন বিধানই দেওয়া আছে।অকালবোধনের সময় মহিষাসুরমর্দিনীকে গড়তে হবে পতিতাপল্লীর মৃত্তিকাতেই। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে এই মাটি লেপতেই হবে চিন্ময়ীর কাঠামোয়। আসলে সমাজ যাদের অশুদ্ধ বা অসূচি বলে, আদিশক্তি মহামায়া কিন্তু তাদেরই কাছে টেনে নিয়েছেন। তাঁর ত্রিনয়নে সকলেই সমান।
Discussion about this post