শারদীয়া দুর্গাপুজার সূচনা হয়েছিল রামচন্দ্রের অকাল বোধনের মধ্যে দিয়ে। পৌরাণিক এই গল্প আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই অকাল বোধনের আগেই এই বঙ্গে এক দুর্গাপুজোর সূচনা হয়ে যায় সেই খবর কি আপনারা রাখেন? মহালয়ার আকাল বোধনেরও আগে আদ্রা নক্ষত্র যোগে কৃষ্ণা নবমী তিথি বা নব্যমাদিকল্পে বাঁকুড়ার মল্লরাজাদের বড়ঠাকুরানীর পুজোর সূচনা হয়ে যায়। মল্লরাজ পরিবারের প্রাচীন রীতি মেনে আজও ৯ বার কামানের তোপ দাগা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে এমনিতেই সমৃদ্ধ বাঁকুড়া। সেই বাঁকুড়াতেই মল্লরাজাদের কূলদেবী মৃন্ময়ীর আরাধনা হয়ে আসছে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। আর এই রাজপরিবারে দশভূজার আগমন ঘটে দুর্গাপুজোর সপ্তাহদুয়েক আগেই। অর্থাৎ মহালয়ারও আগে। এবার এই পুজো ১০২৮ বছরে পদার্পন করল। এই পুজোর আচার ও রীতি বেশ অভিনব। যেহেতু দেবী মৃন্ময়ী হলেন মল্লরাজাদের কুলদেবী, সেহেতু তিনি সারা বছরই বিষ্ণুপুর শহরে রাজ পরিবারের মূল মন্দিরেই পুজিতা হন। তবে দুর্গাপুজোর দুই সপ্তাহ আগে আদ্রা নক্ষত্র যোগে কৃষ্ণা নবমী তিথিতে যাঁর আগমন ঘটে তিনি বড়ঠাকুরানী। মল্লরাজ পরিবারের কথায়, বড়ঠাকুরানী হলেন, দেবী মহাকালী। স্থানীয় গোপাল সায়রের ঘাটে দেবীর শুদ্ধাচারে স্নানপর্ব শেষে মহাধুমধামে তাঁর প্রবেশ হয় প্রাচীন মন্দিরে। এই সময় তিনটি বিশেষ রীতি পালনের পর তিনবার করে কামানের তোপ দাগা হয়।
রাজপরিবারের সদস্য জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ জানিয়েছেন, বড়ঠাকুরানীর প্রবেশের পর দুর্গাপুজোর চতুর্থী তিথিতে মন্দিরে প্রবেশ করবেন মেজঠাকুরানী বা দেবী মহালক্ষ্মী। আবার সপ্তমী তিথিতে আসবেন ছোটঠাকুরানী বা মহা সরস্বতী। আর অষ্টমীর দিন মহা সন্ধিক্ষণে এই মন্দিরে প্রবেশ করবেন অষ্টদশভূজা বিশালাক্ষী দেবী। সেই ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুরের ১৯তম মল্লরাজ জগৎমল্ল পিতৃপক্ষেই এই জিতাষ্টমী তিথিতে শুরু করেছিলেন রাজ পরিবারের আরাধ্য দেবী মৃণ্ময়ীর এই শারদীয়া পুজো। যা আজও বংশপরম্পরায় চলে আসছে নিষ্ঠার সঙ্গে।
মল্লরাজ পরিবারের ইতিহাস বলছে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের আগে মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদ্যুম্নপুর এলাকায়। ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের কোনও এক সময়ে মল্লরাজ জগৎমল্ল শিকার করতে বেরিয়ে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন। কথিত আছে, পথের খোঁজ করতে গিয়ে ক্লান্ত জগৎমল্ল একসময় বট গাছের তলায় বসে পড়েন। সেখানেই নানা অলৌকিক কাণ্ডকারখানার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। শেষে রাজা ওই বট গাছের নিচেই দেবী মৃন্ময়ীর মন্দির স্থাপন করার দৈববাণী পান। নির্দেশ মোতাবেক রাজা জগৎমল্ল সেই বট গাছের নিচেই দেবীর সুবিশাল মন্দির তৈরী করেছিলেন। পাশাপাশি, ঘন জঙ্গল কেটে রাজধানী সরিয়ে আনেন বিষ্ণুপুরে।
তার পর দীর্ঘ ১০২৮ বছর ধরে বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী রয়েছেন মল্লরাজাদের কূলদেবী মৃন্ময়ী। পরবর্তীতে মল্ল রাজারা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হলেও শব্দকে ব্রহ্ম জ্ঞান করে তোপধ্বনীর প্রচলন শুরু করেন। সেই প্রথা আজও চলে আসছে। বিষ্ণুপুরের রাজপরিবার দেবী মৃন্ময়ীয় পুজো হয় ‘বলিনারায়নি’ নামে একটি প্রাচীন বিশেষ পুঁথি অনুসারে। কালের নিয়মে আজ সেই রাজত্বও নেই, সেই জাঁকজমকও নেই। তবে কামানের তোপধ্বনি রয়ে গিয়েছে প্রাচীন এই ঐতিহ্য মেনে। বড়ঠাকুরানী, মেজঠাকুরানী ও ছোটঠাকুরানীর পট ঘিরে রয়েছে অজস্র গল্পগাথা। ফলে আজ ১০২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে মল্লরাজ পরিবারের দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে ভিড় করেন স্থানীয় মানুষজন এবং দূরদূরান্তের পর্যটকরা।
Discussion about this post