একদিকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান রাশিয়া সফরে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ঢাকায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, দুজন দুদিকে নিজেদের মতো করে গুটি সাজাচ্ছেন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সাক্ষাৎ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। আশ্চর্যজনকভাবে সেই সাক্ষাৎপর্ব নিয়ে দু-দেশের দেওয়া বিবৃতি ছিল একেবারে ভিন্ন। যে কোনও কূটনৈতিক বৈঠকে সাধারণত এই ধরণের ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় না। আবার, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান আচমকা কেন রাশিয়ায় গেলেন, সেটা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নানান জল্পনা। কারণ, কয়েকদিন পরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির পুতিন ভারত সফরে আসছেন। তবে কি ভিতর ভিতর কোনও ঘোঁট পাকছে?
বুধবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন ২০২৫-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া ভাষণ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ওই ভাষণের শুরুতেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন মুহাম্মদ ইউনূস। কাকতালীয়ভাবে একদিকে যখন বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনের তোড়জোড় চলছে, অন্যদিকে ঢাকার রাস্তায় গাজায় ইজরায়েলি হামলার প্রতিবাদের নামে লটুপাট, ভাঙচুর, খাবার লুট করে খাওয়ার সেই ৫ অগাস্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল বাংলাদেশে। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহীর মতো শহরেও একাধিক নামী-দামী সংস্থার আউটলেটে হামলা ও লুটপাট চলে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সেই ৫ আগস্টের আগে পরে। সিলেটে কেএফসির বিপণীতে ঢুকে ভাঙচুর করার পাশাপাশি সেখানকার খাবার লুট করে দুস্কৃতিরা। দেখা যায়, দু-হাত ভরে চিকেনের নানা পদ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন বিক্ষোভকারীরা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে উল্লাশ করতে করতে খাবার খায় তারা। একই চিত্র দেখা যায় বাটার শোরুমেও। ভাঙচুরের পাশাপাশি বাটা শোরুমের যাবতীয় জুতো লুট নিয়ে যায় বিক্ষোভকারীরা। ঘটনার সময় অদূরেই ছিল পুলিশ ও সেনাবাহিনীর জওয়নারা। কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হামলা, লুটপাট চলার পর পুলিশ ও সেনা অ্যাকশনে নামে।
ভারত বরাবরই দাবি করে আসছে বাংলাদেশ এখন জঙ্গি, কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠনগুলির স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে। এদিনও দেখা গেল ভারতের দাবি সত্যি করে তৌহিদি জনতা বলে পরিচয় দেওয়া একদল দুস্কৃতি এই কাণ্ড ঘটালেন। আর বাংলাদেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনী কার্যত দাঁড়িয়ে দেখলেন, কারণ উপর থেকে নির্দেশ আসেনি তাই। অপরদিকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিশ্বকে বদলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ক্রেজি আইডিয়ার দেশ…বাংলাদেশ তা সম্ভব করেও তুলছে। ঢাকার অভিজাত হোটেলে বিনিয়োগ সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন মুহাম্মদ ইউনূস গোটা বিশ্বকে আহ্বান জানাচ্ছেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য। তখন নিরবে ভারত একটা বড় পদক্ষেপ নিয়ে নেয়। যা বাংলাদেশের বৈদশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা হতে চলেছে। জানা যাচ্ছে, ৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় পরোক্ষ কর ও শুল্ক বোর্ড বা সিবিআইসি কর্তৃক জারি করা একটি সার্কুলারের মাধ্যমে জানিয়েছে ভারত সরকার বাংলাদেশকে দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। যা তাঁদের রফতানি পণ্যগুলিকে ভারতীয় স্থল শুল্ক স্টেশন, সমুদ্র বন্দর এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পরিবহনের অনুমতি দিত।
২০২০ সালের জুন মাসে চালু হওয়া এই সুবিধা নেপাল, ভুটান এবং মায়ানমারের মতো দেশগুলিতে বাংলাদেশি পণ্য রফতানির জন্য মসৃণ বাণিজ্যকে সক্ষম করে তুলেছিল। ভারত এই সুবিধা বাতিল করায় চরম বিপাকে পড়বে বাংলাদেশের বৈদশিক বাণিজ্য, এমনটাই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, দিন কয়েক আগেই থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মুহাম্মদ ইউনূস প্রথমবার সাক্ষাৎ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। কিন্তু ওই বৈঠকের পরই বাংলাদেশের প্রেস সচিব বেশ বড়াই করে দাবি করেছিলেন, মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছেন। পাশাপাশি ভারতের সামনে বাংলাদেশের স্বার্থ সম্বলিত সমস্ত দাবি তুলে ধরেছেন। তার আগে, চিনে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে ল্যান্ডলক বলে উল্লেথ করে চিনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের পক্ষে কথা বলে এসেছিলেন।
এটা ভারতের কাছে একটা বড় হুমকি বলেই বিবেচনা করছেন কূটনৈতিক মহল। এবার ভারত বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে মোক্ষম জবাব দিল। জানা যাচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার বাণিজ্য করে। এবার তা আটকে যাবে। অন্যদিকে রাশিয়ায় গিয়ে সেনাপ্রধান একের পর এক বৈঠক করছেন সে দেশের সামরিক কর্তাদের সঙ্গে। তারপরেই ভারতে আসছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির পুতিন। ফলে এই ত্রিশক্তি জোট এবার চাপে ফেলবে বাংলাদেশকে। তখন বোঝা যাবে কে আসলে “গার্ডিয়ান অফ দ্য ওসেন”।
Discussion about this post