সময়টা ছিল ১০৫১ সাল। ভারত সবে মাত্র স্বাধীন হয়েছে। দেশীয় উদ্যোগে কলকারখানা স্থপনের তোড়জোর চলছে ভারতে। এই আবহেই হরিয়ানার সোনিপথে জানকি দাস কাপুর স্থাপন করলেন একটি সাইকেল কারখানা। যার নাম অ্যাটলাস সাইকেল। দেশবাসীকে উন্নতমানের সাইকেল সরবরাহের জন্য তিনি সোনিপথে ২৫ একর জায়গায় এই কারখানা চালু করেন। প্রথম বছরেই এই কারখানা থেকে তৈরি হয়েছিল ১২ হাজার সাইকেল। দিনে দিনে অ্যাটলাস সাইকেলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠতে শুরু করে। আত্মপ্রকাশের সাত বছরের মধ্যেই ১৯৫৮ অ্যাটলাস সাইকেল প্রথম বিদেশে রফতানি শুরু করে দেয়। ১৯৬৫ সালের মঘ্যেই এই কোম্পানি ভারতের এক নম্বর সাইকেল প্রস্তুতকারক সংস্থায় আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু কালের নিয়মে আজ বন্ধই হয়ে গিয়েছে অ্যাটলাস সাইকেল উৎপাদন। বন্ধ হয়েছে তাঁদের একের পর এক কারখানা। কেন এই অবস্থা হল অ্যাটলাস সাইকেলের?
কেন বন্ধ হয়ে গেল অ্যাটলাস সাইকেল সেটা নিয়ে আলোচনার আগে জেনে নেওয়া যাক কোম্পানি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য। ১৯৬৫ সাল থেকে দীর্ঘদিন অ্যাটলাস সাইকেল ভারতের বৃহত্তম সাইকেল প্রস্তুতকারী সংস্থা ছিল। এই সময়কালে একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে সংস্থা। যেমন, ইতালির গোল্ড মার্কারি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ‘বেস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস’-এর জন্য এফআইসিসিআই অ্যাওয়ার্ড। ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়াডে অ্যাটলাস কোম্পানি আনুষ্ঠানিক সরবরাহকারী হিসেবে অংশগ্রহন করেছিল। ১৯৫৮ সালে বিশ্ব বাজারে আত্মপ্রকাশ করে অ্যাটলাস মধ্যপ্রাচ্য, মিয়ানমার, বাংলাদেশ-সহ আফ্রিকার একাধিক দেশে সাইকেল রফতানি করেছে। ফলে রফতানি শ্রেষ্ঠত্বের জন্য অ্যাটলাস কোম্পানি ইইপিসি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল। বাজারে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে এবং আরও লাভজনক হতে এই কোম্পানি গুরগাঁওয়ে নিজেদের উদ্যোগে একটি ইস্পাত টিউব কারখানাও তৈরি করেছিল। ফলে তাঁরা সাইকেল তৈরির মূল কাঠামো ইস্পাতের টিউব অনেক কম খরচে তৈরি করত। অ্যাটলাস ভারতে প্রথম রেসিং সাইকেল তৈরি করে ১৯৭৮ সালে। এমনকি ভারতের প্রথম সাইকেল নির্মাতা হিসেবে পাওয়ার ব্রেকিং সিস্টেম নিয়ে আসে অ্যাটলাস। কোম্পানি ধীরে ধীরে সারা দেশে ৮০০-র বেশি ডিলার নিয়োগ করেছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে অ্যাটলাস সাইকেল ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সাইকেল প্রস্তুতকারী কোম্পানি হয়ে উঠেছিল।
তবুও ২০১৪ সালের পর অ্যাটলাস সাইকেল মন্দার দিকে এগোতে থাকে। বন্ধ হতে থাকে তাঁদের একের পর এক কারখানা। কারণ হিসেবে উঠে আসছে মূলত সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো এবং আধুনিক পরিকল্পনার অভাব। আর অ্যাটলাস সাইকেল পতনে শেষ পেরেক পুতে দেয় করোনা ভাইরাসের প্রকোপ এবং লকডাউন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজ মোটরবাইকের দিকে ঝূঁকতে শুরু করে। ফলে কদর কমে সাইকেলের। অন্যদিকে হাল ফ্যাসানের বিভিন্ন সাইকেলের পসরা সাজিয়ে চিনের বিভিন্ন কোম্পানি ভারতের বাজার দখল করতে শুরু করে। ভারতের যুবসমাজ যখন ক্রমবর্ধমান আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর বাইসাইকেলের দিকে ঝুঁকছে, তখন অ্যাটলাস সাইকেল সেখানে অনেকটাই তাল মেলাতে পারেনি। ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার বেশিরভাগই ছিল ৫৫ বছরের নীচে। ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুরা যেমন হাল ফ্যাসানের সাইকেল পছন্দ করে, তেমনই ১৮ থেকে ১৫ বছর বয়সী মহিলাদেরও পছন্দ ঝাঁ চকচকে রঙিন সাইকেল। অ্যাটলাস সাইকেল এই ধারার সাইকেল তৈরির ধারেকাছে ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারায় সংস্থা।
বিগত ১০ বছরে অ্যাটলাস সাইকেলের তিনটি কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালে কোম্পানি তাঁদের মধ্যপ্রদেশের মালনপুরের ইউনিট বন্ধ করে প্রথমে। এরপর ২০১৮ সালে হরিয়ানার সোনিপথে অ্যাটলাস সাইকেলের প্রথম ইউনিট বন্ধ করে। সব শেষে করোনাকালের পর ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশের সাহিদাবাদে তাঁদের শেষ ইউনিটটিও বন্ধ করে দেয়। ফলে অবসান ঘটে স্বাধীন ভারতের অন্যতম শিল্প সংস্থার।
Discussion about this post