১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, ঘরির কাঁটা তখন রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। গোটা দেশ অধীর আগ্রহে রেডিওতে কান পেতে বসে রয়েছে। সেদিন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এক অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর একটি উক্তি বিশ্বের যে কোনও দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। পণ্ডিত নেহেরু বলেছিলেন, “বিশ্ব যখন ঘুমে মগ্ন, তখন মধ্যরাতের এই উন্মাদনায় ভারত জীবন এবং স্বাধীনতায় জেগে উঠবে। এমন কিছু মুহূর্ত আছে যা ইতিহাসে কম সময়ের জন্য জন্য আসে। যখন আমরা পুরাতন থেকে নতুনের দিকে পা বাড়াই, যখন একটি যুগ শেষ হয় এবং যখন দীর্ঘ নিপীড়িত জাতির আত্মা স্বর খুঁজে পায়। সেই গৌরবময় মুহুর্ত উপযুক্ত সময় ভারত ও তার জনগণের সেবা এবং মানবতার আরও বৃহত্তর উদ্দেশ্যের প্রতি উৎসর্গের অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য”। স্বাধীনতার ৭৮তম বর্ষে এসে পণ্ডিত নেহেরুর সেই আমোঘ বাণীই যেন ফিরে এল এই বাংলার বুকে। সেই ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রী, সেই উন্মাদনা। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতটা সম্পূর্ণ আলাদা। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে গোটা দেশ দেখল এক অভূতপূর্ব আন্দোলন। যা একেবারেই সংগঠিত নয়, কোনও রাজনৈতিক দলের ডাকে নয়, কোনও পতাকা বা ব্যানারের নীচে নয়। বরং সম্পূর্ণ স্বতপ্রণোদিত, স্বতস্ফুর্ত এক অভ্যুত্থান যেন। কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষিতা হয়ে খুন হওয়ার প্রতিবাদ। স্ফুলিঙ্গের আকার থেকে সেই প্রতিবাদের ভাষা দাবানলের আকার নিয়ে নিল সাড়া বাংলায়। কলকাতায় কয়েকজন মহিলার কল্পনাপ্রসুত এক প্রতিবাদ কর্মসূচি ছড়িয়ে পরল গোটা বাংলায়। মাত্র ২৪ ঘণ্টায় যা এক অভ্যুত্থানের রূপ নিয়ে নিয়েছিল। কাকদ্বীপ থেকে কালিম্পঙ, পুরুলিয়া থেকে পাথরপ্রতিমা, শিলিগুড়ি থেকে শিয়ালদা, রাজ্যের প্রতিটি কোনায় মহিলারা মধ্যরাতে রাস্তা দখল করলেন। শুধুই কি এই বাংলা, দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, মুম্বই, দেশের অনেক বড় শহরও আর জি করের সেই হতভাগা মহিলা চিকিৎসকের জন্য রাস্তায় হাঁটলেন স্বাধীনতার মধ্যরাতে।
কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশের উত্তাল ছাত্র আন্দোলন দেখেছে গোটা বিশ্ব। সেখানেও সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় সরকার উৎখাতের আন্দোলনে। লাগাতার আন্দোলনের জেরে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশের জনগণ এটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছে। বাংলাদেশের পড়শি দেশ ভারত, তারই অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ আবার বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক দিক থেকে খুব একটা পার্যক্য নেই। ফলে বাংলাদেশের আন্দোলনের আঁচ হয়তো খুব জলদি এসে পড়ল এপার বাংলাতেও। এমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও অভিযোগ তাই। বেহালায় এক অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজ্যজুড়ে মহিলাদের মধ্যরাতে রাস্তা দখল কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটা ঘটনা ঘটেছে। অনেকে ভেবেছেন, এই ঘটনা টেনে এনে যদি ক্ষমতা দখল করতে পারেন। শুনে রাখুন, আমার ক্ষমতার মায়া নেই। আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।
ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, মহিলাদের এভাবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা নিয়ে ভয় পেয়েছে রাজ্যের শাসকদল। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীর কথাতেও তাঁর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হল, কলকাতার বুকে আর জি কর হাসপাতালের ভিতরেই যখন মহিলা চিকিৎসক নির্যাতিতা হলেন, খুন হলেন, তখন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল আম জনতার। স্বাধীনতার মধ্যরাতে নারী স্বাধীনতার দাবিতে রাস্তায় নামলেন হাজার হাজার মহিলা। তাঁরা শুধু বিচার চায়। কেন একজন কর্তব্যরত চিকিৎসককে এভাবে ধর্ষিতা হতে হবে, কেন তাঁকে মরতে হবে? প্রকৃত দোষী কারা? এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই মাঝরাতে মোমবাতি, শঙ্খ নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়েছিলেন রাজ্যের আট থেকে আশির মহিলারা। এই আন্দোলন একেবারেই অন্য মাত্রা এনে দেয় ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে অনুষ্ঠিত হওয়ায়। আজকের প্রজন্ম জানেই না ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের রাতে কি হয়েছিল। কিন্তু নারীদের স্বাধীনতা, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে, সমাজে তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তাঁরা পথে নামেন। আর এই আন্দোলনই দেখিয়ে দিল, কন্যাসন্তানের অভিবাবকদের দুস্চিন্তা, আশঙ্কা কোন পর্যায়ে রয়েছে। যা স্বাঘীনতার ৭৭ বছর পরও কাটেনি।
Discussion about this post