বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুই পা এগিয়েও কেন এক পা পিছিয়ে আসছে ভারত? বর্তমানে এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট ও বিশ্বস্ত সূত্র থেকে একটা কথা পরিষ্কার, ভারত সরকার ক্রমাগত চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে। বিশেষ করে মুহাম্মদ ইউনূসের এই অবৈধ সরকারকে হঠাতে এবং সেখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত একটি সরকারকে পুর্ণস্থাপিত করতে সচেষ্ট ভারত। কিন্তু কেন বারবার পিছিয়ে আসতে হচ্ছে ভারতকে? বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করলে, অথবা আন্তর্জাতিক বা প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত কে গুরুত্ব দিলে একটাই ব্যাপার সামনে আসছে সেটা হল পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। যা প্রতিপদে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। সেটা কেন, আজ এই বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সেই দেশ একটা গৃহযুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, বিশেষ করে সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি একটা দাবি নিয়ে তুমুল আন্দোলনে নেমেছে। সেটা হল, আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় প্রবেশ করতে কোনও ভাবেই প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না, এটাই তাঁদের মূল বক্তব্য। সেই সঙ্গে তাঁরা শেখ হাসিনাকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া ভারতকেও ক্রমাগত আক্রমণ করে চলেছে। তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, আওয়ামী লীগ বা হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরাতে তৎপর ভারত। আর এর জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে ভারত। ফলে একটা প্রশ্ন অবধারিত ভাবেই উঠতে পারে, কেন জাতীয় নাগরিক পার্টি এই ধরণের অভিযোগ তুলছে? এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, জাতীয় নাগরিক পার্টি হল সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নবতম সংযোজন। হলে তাদের দাবিতে একটা গুরুত্ব অবশ্যই থাকবে। এবার আসা যাক এই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোথা থেকে উৎপত্তি হয়েছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটা পরিষ্কার যে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বা তাদের নিয়ন্ত্রিত ডিপ স্টেট বাংলাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনের মূল কান্ডারী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার গঠনের পিছনে ডিপ স্টেট যেমন বনভূমিকা নিয়েছিল তেমনি একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল পাকিস্তানের আইএসআই। কিন্তু আমাদের কৌতুহল হল কেন ভারত সরকার এই ধরণের ঘটনা প্রতিহত করতে পারছে না। আবার এই প্রশ্নও উঠছে, কেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বড় কোনও পদক্ষেপ নিতে এতটা সময় নিচ্ছে ভারত। যেখানে ধারে, ভারে ভারত অনেকটাই এগিয়ে বাংলাদেশের থেকে।
প্রতিরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের কথায়, শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে কট্টরপন্থী ইসলামিক সংগঠন বা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি একেবারেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। হাসিনা ভারত সরকারের তথ্য মোতাবেক ধরে ধরে জঙ্গি নেতাদের জেলে ভরেছিলেন। যাদের মুহাম্মদ ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসেই জেলমুক্তি দিয়েছিলেন। হাসিনা বরাবরই ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে এসেছিলেন। এমনকি তাঁর জন্য চিন সফরে গিয়েও তাঁকে চরম হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল। আমরা জানি, তাঁকে চিনা সরকার প্রটোকল অনুয়ায়ী কোনও প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি। ফলে তিনি সেই সফরের মাঝপথে দেশে ফিরেছিলেন। এবার শোনা যাচ্ছে মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজকীয় মর্যাদায় চিন আমন্ত্রণ জানিয়েছে, এবং ইউনূস আগামী ২৫ কিংবা ২৬ ফেব্রুয়ারি চিন সফরে যেতে পারেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, কে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারতের কূটনৈতিক মহলের বক্তব্য, যতদিন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ততদিন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে শান্তি বিরাজ করছিল। এটাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার গুরুত্ব বোঝাতে যথেষ্ট। ভৌগলিকভাবেও বাংলাদেশ ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত চার হাজার কিলোমিটারের বেশি। এরমধ্যে ২,১০০ কিলোমিটার তো শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই জড়িত। আমরা জানি, এই বিস্তৃর্ণ আন্তর্জাতিক সীমান্তের অনেকটা অংশই ছিল অরক্ষিত। অর্থাৎ কাঁটাতার বিহীন। আর এই কাঁটাতার না দিতে পারার কারণই হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদাসীনতা। যেমন, জমি অধিগ্রহন না করে দেওয়া। ফলে এই অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে যেমন, দীর্ঘ সময় ধরে বেআইনী অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে, তেমনই বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি নেটওয়ার্ক এবং তাঁদের হ্যান্ডলাররা অবাধে ভারতে প্রবেশ করে আসছিল। যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে একটা বড় হুমকি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার এটা কিছুতেই মেনে নিচ্ছিল না। বরং তাঁরা বেআইনি অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ক্ষেত্রে কোনও ভাবেই বিএসএফ-কে সহযগিতা করছিল না। একটা সময় হাসিনা উপলব্ধি করেছিলেন, জামায়তে মুজাহিদিন বাংলাদেশ এবং জামায়তে ইসলামীর বড় বড় নেতাকেও তিনি ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিলেন। এমনকি অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠী যারা উত্তর-পূর্ব ভারতে সক্রিয় ছিল তাঁদের নেতৃত্বকেও ধরে ধরে জেলে ভরেছিলেন। উদারহণ হিসেবে বলা যেতে পারে আলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যখন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা জামায়তে মুজাহিদিন বাংলাদেশ এবং জামায়তে ইসলামীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে শুরু করেছিলেন। আপনাদের মনে থাকবে, একসময় জামায়তে মুজাহিদিন বাংলাদেশ একই সময় প্রায় ৪০০ জায়গায় একই সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা সে সময় ধরপাকড় শুরু করতেই তাঁদের বহু নেতা-সদস্য কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে চলে আসে এবং পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয় পান। অনেকেই মনে করেন, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির কারণে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকার, সেটা দেখেও না দেখার ভান করেন। কিন্তু বাস্তব হল, সে সময়ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি বারবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সতর্ক করেছিল।
বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টেছে। শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দাবি করেছেন, হাসিনাবিরোধী আন্দোলন যে বড় আকার নিতে পারে সেটা গোয়েন্দারা আঁচ করেছিলেন। কিন্তু ভারতের কিছু করার ছিল না। ভারত কেবলমাত্র পরামর্শ দিতে পারতো, এবং সেটা তাঁরা দিয়েছিল। সেই সঙ্গে পালাবদলের পর হাসিনাকে কোনও ভাবে ভারতে এনে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর দোসরদের যা পরিকল্পনা, তাতে ভারত নিশ্চই সিঁদূরে মেঘ দেখছে। ফলে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল একটা পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশে স্থিতিশিলতা ফিরিয়ে আনতে। তিনি কেন তিনদিন ধরে কলকাতায় এসে অবস্থান করেছিলেন সেটা এখন পরিস্কার। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্য কেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার জমি দিতে রাজি হল সেটা এখন পরিস্কার। ফলে সীমান্ত সুরক্ষিত করে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ কার্যত বন্ধ করা গিয়েছে। আগামীদিনে পুরোটা বন্ধ করা সম্ভব হবে। এবার ভারতের অ্যাকশন শুরু হবে। যাতে জঙ্গি, সন্ত্রাসীরা কোনও ভাবে কাঁটাতার পেরোতে না পারে। পথের কাঁটা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জমি অধিগ্রহণ পলিসি। অজিত ডোভালের কুশলী চালে সেটাও এখন মিটেছে।
Discussion about this post