বাংলাদেশ এখন কার্যত দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভুত এবং অন্যটি ২৪-এর বিপ্লব বা দ্বিতীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আর এই দুই পক্ষের মধ্যে যে কোনও সময় যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। আর এই আশঙ্কার আবহেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। মঙ্গলবার প্রাক স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন বর্তমান এবং সাবেক। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে তাঁর বিগত সাড়ে সাত মাসের সাফল্যের ঢোল বাজিয়েছেন। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের অজ্ঞাতবাস থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া এক ভাষণে ইউনূসের ঢোল ফাটিয়ে দিলেন। দুজনের তু তু ম্যায় ম্যায় শুনে চরম বিভ্রান্ত বাংলাদেশের জনগণ।
ইতিমধ্যেই একটা বিষয় পরিস্কার, বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান যে স্বতঃস্ফুর্ত ছিল না, সেটা একটা বড় ষড়যন্ত্র ছিল। স্বয়ং মুহাম্মদ ইউনূসের কথায়, মেটিকুলাস ডিজাইন। ফলে শেখ হাসিনাকে ষড়যন্ত্র করেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও নেত্রী হাসিনার দাবি, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে এবং বাংলাদেশের বুকে অহেতুক রক্তপাত রুখতেই দেশ ছেড়েছিলেন। পরবর্তী সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা সেনাপ্রধানও শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র নিয়ে কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু বাস্তব হল, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছে। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ইউনূসের দাবি, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এই রমজানে দ্রব্যমূল্য আগের তুলনায় কমেছে, জনগণ স্বস্তি পেয়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে এই প্রচেষ্টা চলমান থাকবে। ইউনূস আরও দাবি করেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাঙ্কিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, ক্রমান্বয়ে অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করছে। মূল্যস্ফীতি ৯.৩২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
উল্টো দিকে শেখ হাসিনা সরাসরি অভিযোগ করছেন, ইউনূস গরীবের রক্ত চুষে খাচ্ছেন। তিনি বলেন, যে বাংলাদেশকে তিনি একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশকে নিঃস্ব করে দিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূস। এমনকি রমজানে জিনিসপত্রের দামও কমেনি বাংলাদেশে। যা দেখানো হচ্ছে, সে সবই জোর করে। এই বিষয়ে তিনি পরিসংখ্যানও দেন ওই ভার্চুয়াল বার্তায়।
বিগত সাত মাসে মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের কোন উপকার করলেন? প্রশ্নকর্তা স্বয়ং শেখ হাসিনা। তবে বাংলাদেশ যে ক্রমশ এক অরাজক দেশে পরিনত হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারেই নেই বললে চলে। তা এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের মুখে শুধুই হাসিনা আমলের বদনাম। কথায় কথায় ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারি শব্দ ব্যবহার করে আগের আমলকে আক্রমণ করতে ব্যস্ত মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর অনুগত ছাত্র নেতারা। প্রাক স্বাধীনতা ভাষণেও ইউনূস সেই হাসিনা আমলের কথা উঠে এল। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমরা দেখেছি বাংলাদেশে একের পর এক ভয়ানক অপরাধী এবং জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। বিএনপি, জামাতের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে থাকা, গণহত্যা বা গুরুতর অপরাধের বহু মামলা প্রত্যাহার করে তাঁদের জেলমুক্তি দেওয়া হয়েছে। ইউনূসের কথায়, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার এগুলো নাকি মিথ্যে অভিযোগে দায়ের করেছিল। এমন ২,৬৯৫টি মামলার কথা তিনি উল্লেখ করেন।
আদতেও দেখা গিয়েছে, মামলা প্রত্যাহার করে একাধিক জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতাকে জেলমুক্তি দিয়েছে ইউনূস সরকার। আবার তিনিই আওয়ামী লীগকে সক্রিয় না হতে দেওয়ার জন্য অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার পাল্টা অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তদারকি সরকার আওয়ামী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। আর নিজেদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা তুলে নিচ্ছে।
শান্তির নোবেলজয়ী ইউনূস বাংলাদেশেই শান্তি ফেরাতে পারলেন না সাত মাসের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে। অথচ তিনি বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা বা ৭১-এর স্বাধীনতাকেই কার্যত অস্বীকার করে চলেছেন। স্বাধীনতা দিবসের ভাষণেও তাঁর মুখে বার বার ঘুরে ফিরে আসছে ২০১৪-এর আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান ও জুলাই বিপ্লবের কথা। তাঁর কথায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তার মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল সবচাইতে বেশি। গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা দুঃসাহসিক ভূমিকা রেখেছে। পুরোনোকে দূরে ঠেলে দিয়ে নতুনের ভিত্তি স্থাপনের প্রতিজ্ঞা নিয়েছে। তারা ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছে। সর্বত্র নারীদের ভূমিকা আরও জোরালো করার কথা বলেছে। আমি মনে করি, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বদলে দিয়েছে। সবকিছুর মধ্যেও তিনি নির্বাচন নিয়ে যে সামান্য সময় ব্যায় করলেন এই ভাষণে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূস মুখে যতই বলুক, আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, কিন্তু তাঁর অনুগামী ছাত্রনেতারা চাইছেন আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েই নির্বাচনে যেতে। এটা রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছুই মনে করছেন না রাজনতিক মহলের একাংশ।
Discussion about this post