বৃহস্পতিবার নবান্ন সভাগৃহে মঞ্চ প্রস্তুত ছিল, সব পক্ষের কূশীলবরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য প্রশাসনের আলোচনা ভেস্তে গিয়েছিল। শুধুমাত্র ওই আলোচনার লাইভ স্ট্রিমিং বা সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে জুনিয়র চিকিৎসকদের এই দাবিতেই না বলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। আর দুই পক্ষের এই জেদাজেদিতেই সেদিন ভেস্তে গিয়েছিল আলোচনা। কিন্তু একদিন পর অর্থাৎ শনিবার যে ঘটনাটা স্বাস্থ্যভবনের সামনে ঘটে গেল সেটা জনসমক্ষে এবং সমস্ত মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে। মজার ব্যাপার এই ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার হল। অর্থাৎ লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবিকে মান্যতা না দেওয়া নিয়ে যে বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল জনমানসে, এদিন সেটাকেই সপাটে উড়িয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শনিবার স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থানরত জুনিয়র চিকিৎসকদের মঞ্চে বিনা নোটিশে নিজে উপস্থিত হয়ে জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনেই নতুন করে আলোচনার দরজা খুলে দিয়ে গেলেন তিনি। আর এই ঘটনা এতটাই আচমকা হল যে শুধুমাত্র আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকরাই নয়, গোটা বাংলার মানুষই প্রায় হতচকিত হয়ে পড়েছেন। কেন তিনি আচমকা উপস্থিত হলেন জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন মঞ্চে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই।
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল আর জি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত এক তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ এবং খুনের মামলা। কলকাতা হাইকোর্টে মামলা শুরু হলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত যা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে শুনছে। গত ৯ আগস্ট ঘটে যাওয়া এই নারকীয় ঘটনার পর কেটে গিয়েছে ৩৪ দিন। এখনও কাটেনি রহস্য, একজন বাদে ধরা পড়েনি আর কেউ। ঘটনার পরই হাসপাতালে নিরাপত্তার অভাব এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ জানিয়ে এবং নির্যাতিতার দ্রুত বিচার চেয়ে কর্মবিরতি শুরু করেন পড়ুয়া চিকিৎসকরা। যা এখনও অব্যাহত। আন্দোলনরত পড়ুয়া চিকিৎসকদের পাঁচ দফা স্পষ্ট দাবি। যা নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার বার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই বৈঠন ভেস্তে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীও সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করেন, তিনি চেয়েছিলেন আলোচনা হোক। তিনি এমনও দাবি করেন, প্রয়োজনে তিনি পদত্যাগও করতে পারি। কিন্তু ওরা বিচার চায় না, চেয়ার চায়। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায় আন্দোলনরত চিকিৎসকরা। যা নিয়ে আবারও বিড়ম্বনায় পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এদিন সেই ক্ষতেই প্রলেপ দিতে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন নিজেকে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের উর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে ধর্ণামঞ্চে গিয়েছিলেন। তেমনই প্রশাসনের প্রধান হিসেবে নিজের দায়িত্বও পালন করেছেন বলে মনে করছেন অনেকে। একদিকে তিনি যেমন বলেন, আমি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নন, বড় দিদির মতো আপনাদের কাছে এসেছি। আমি সমব্যথী, সমসাথী। অন্যদিকে তাঁর বক্তৃতার মাঝেই যখন উই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগান ওঠে, তখন মুখ্যমন্ত্রী স্বভাবসূলভ ভঙ্গিমায় সিবিআইয়ের কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, মুখ্যমন্ত্রী সুকৌশলে এদিন দুর্নীতির দায় নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার মরিয়া চেষ্টা করলেন।
পাশাপাশি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলিতে দুর্নীতি নিয়ে যে অভিযোগ করে আসছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা, সেটাও সুকৌশলে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা এদিন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, হাসপাতালগুলিতে কি টেন্ডার হচ্ছে বা কোথায় কি টাকা খরচ হচ্ছে তার সবকিছু আমার কাছে আসে না। তবে আমি আপনাদের দাবি মেটানোর চেষ্টা করব। সময় দিন। এমনকি তিনি রাজ্যের সব হাসপাতালের রোগী কল্যান সমিতি ভেঙে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন এই প্রকাশ্য মঞ্চ থেকেই। এদিন তাঁর বলা অনেকগুলি কথার মধ্যে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল। সেটা হল সুপ্রিম কোর্টের শুনানি সংক্রান্ত বক্তব্য। এখানেও তিনি সুকৌশলে আন্দোলনরত পড়ুয়া চিকিৎসকদের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়ে গেলেন। কেস চলছে, ১৭ তারিখ শুনানি আছে। আমি চাই না কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এদিন মুখ্যমন্ত্রী এক ঢিলে অনেকগুলি পাখি মারতেই এসেছিলেন। প্রথমত, গত বৃহস্পতিবার ভেস্তে যাওয়া বৈঠকের যে দায় তাঁর ঘাড়ে চাপছিল, সেটা তিনি এদিন ঝেরে ফেললেন। দ্বিতীয়ত, হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজে যে দুর্নীতির বাসা তৈরি হয়েছিল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তার দায়ও তিনি নিজের কাঁধ থেকে সরানোর চেষ্টা করলেন। আবার জুনিয়র ডাক্তারদের কয়েকটি দাবি প্রকাশ্যে মেনে নিয়ে তিনি নিজের ভাবমূর্তিও কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে চেষ্টা করলেন।
Discussion about this post