শেষ দফায় রাজ্যে ৯টি আসনে ভোট হবে। ওই দিন ভোটগ্রহন চলবে দক্ষিণবঙ্গের উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা ও কলকাতার আসনগুলিতে। এরমধ্যে উত্তর ২৪ পরগণার দমদম, বারাসত ও বসিরহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগণার জয়নগর, মথুরাপুর, যাদবপুর ও ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র রয়েছে। আর রয়েছে কলকাতা উত্তর এবং কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র। এই ৯টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া আসন কোনটি? এই নিয়ে তর্কের অবকাশ রয়েছে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে সন্দেশখালি ইস্যুতে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল। এই সন্দেশখালি বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে। যাদবপুর কেন্দ্র আলোচনায় রয়েছে সায়নী ঘোষ, অনির্বান গাঙ্গুলি এবং সৃজন ভট্টাচার্যের ত্রিমুখী লড়াইয়ের জন্য। একইভাবে দমদমেও ত্রিমুখী লড়াইয়ে জমজমাট। আবার ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে সেভাবে লড়াই না থাকলেও তৃণমূলের যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য নজরে থাকবে। তবে এবার সবচেয়ে আলোচিত কেন্দ্র কলকাতা উত্তর। বিজেপি কলকাতায় দাঁত ফোটাতে পারবে কিনা সেই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু এই কলকাতা উত্তর।
কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে এবার মুখোমুখি দুই দূঁদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। একজন উত্তর কলকাতার তিনবারের সাংসদ। অন্যজন কয়েকদিন আগেও ছিলেন তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতা। তিনি তাপস রায়। লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার দিন কয়েক আগেই তাপস রায় যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে এবং কলকাতা উত্তরের বিজেপি পার্থী। তবে কলকাতা উত্তরে একদিকে যেমন রাজনীতি সচেতন মানুষের বাস, তেমনই ফ্যাক্টর ধর্মীয় ভাবাবেগ। তাই এই কেন্দ্রের প্রার্থী দেওয়ার আগে এই সমস্ত ফ্যাক্টর মাথায় রাখতে হয়। ফলে কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে জনপ্রিয়তা, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং রাজনীতিতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকে বাছাই করা হয়। যেমন, এবার কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী বিদায়ী সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপির প্রার্থী তাপস রায় এবং কংগ্রেসের প্রার্থী বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। তিনজনই সংসদীয় রাজনীতিতে অতি পরিচিত এবং অভিজ্ঞ।
প্রার্থী পরিচয়
লোকসভা নির্বাচনের দামামা বাজার ঠিক আগেই তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়ের বাড়িতে হানা দেয় এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট বা ইডি। এরপরই তাপস রায় সকলকে অবাক করে ইডি হানার জন্য দায়ী করেন উত্তর কলকাতার সাংসদ তথা দলীয় সতীর্থ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এরপরই তাপস রায় তৃণমূল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কথামতো তিনি দলও ছাড়েন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে পদ্মশিবিরে যোগ দেন। তাঁকেই উত্তর কলকাতায় প্রার্থী করে তৃণমূলকে টেক্কা দিতে চেয়েছে বিজেপি শিবির। কারণ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির তাপস রায়ের বিরুদ্ধে এখনও কোনও দুর্নীতির গন্ধ নেই। পাশাপাশি দীর্ঘদিন তৃণমূলে থাকার ফলে তিনি এখানকার সংগঠন হাতের তালুর মতো চেনেন। তাপসের আরেকটি প্লাস পয়েন্ট হল, সুদীপ বিরোধীতা। তিনি তৃণমূলে থাকাকালীনই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করে এসেছেন। এখন তো সরাসরি প্রতিপক্ষ।
অপরদিকে তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর কলকাতা থেকে তিনবারের সাংসদ এবং লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা। এই কেন্দ্রে তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে বলেই তাঁকে এবারও প্রার্থী করেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সুদীপ কোনওদিনই দক্ষ সংগঠক নন। তাঁকে সবসময় এলাকায় পাওয়া যায় না। দিল্লিতেই বেশিরভাগ সময় থাকেন। পাশাপাশি বয়সও একটা বড় ফ্যাক্টর। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় রোজভ্যালি কাণ্ডে এক বছরের বেশি সময় জেলে ছিলেন। ফলে এটাও তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার করছেন বিজেপি প্রার্থী। সবমিলিয়ে এবার যথেষ্ট চাপে তৃণমূলের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাম-কংগ্রেস জোট বেঁধে এবার প্রার্থী করেছে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যকে। তাঁর সমর্থনে ঘনঘন প্রচার করছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু থেকে শুরু করে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। উত্তর কলকাতায় কংগ্রেসের একটা নির্দিষ্ট ভোট রয়েছে। একসময় এখানে কংগ্রেস প্রার্থীরাই জিততেন, যা এখন তৃণমূল শিবিরে চলে গিয়েছে। ফলে বর্ষীয়ান প্রদীপ ভট্টাচার্য যদি সেই ভোটের কিছুটাও ফিরিয়ে আনতে পারেন তবে চাপ বাড়বে তৃণমূলের। অপরদিকে বামফ্রন্ট আলাদা প্রার্থী না দেওয়ায় বামের কিছু ভোট রামে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। সেই দিক থেকে এগিয়ে তাপস রায়।
অতীতের ফলাফল
২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা উত্তরে তৃণমূলের সূদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছিলেন ৯৬ হাজার ২২৬ ভোটে। সেবার তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিজেপির রাহুল সিনহা। তিনি ২৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। অপরদিকে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের মার্জিন অনেকটাই বেড়ে যায়। তৃণমূল প্রার্থী জিতেছিলেন ১ লক্ষ ২৭ হাজার ভোটে। তবুও বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহার ভোট শতাংশ বেড়েছিল ২০১৯ সালে। এবার লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ানে।
ফ্যাক্টর
কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে লড়াই এবার যথেষ্ট আকর্ষণীয় হতে চলেছে এ কথা বলাই বাহুল্য। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে কয়েকটি ফ্যাক্টর তৃণমূলের বিপক্ষে যেতে পারে বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। যেমন, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি। একদিকে দুর্নীতি মামলায় তাঁর নাম জড়ানো, জেলযাত্রা, অন্যদিকে নিজের সংসদীয় এলাকায় জনসংযোগের অভাব। ফলে কলকাতা উত্তরের কয়েকটি বিধানসভায় একটা সুদীপ বিরোধী চোরাস্রোত বইছে। অপরদিকে, সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের দিকেই থাকবে ধরে নিলেও সেই ভোটে এবার সিঁদ কাটবে কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্য। কলকাতা উত্তরের চৌরঙ্গী, মানিকতলা, এন্টালি, শ্যামপুকুরে সংখ্যালঘু ভোটারের আধিক্য রয়েছে। অপরদিকে, জোড়াশাঁকো, বড়বাজার, বেলেঘাটায় এলাকায় অবাঙালি ও বাঙালি হিন্দু ভোটার বিজেপির ক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট হতে পারে। অন্যদিকে লোকসভা নির্বাচনে তাপস রায়ের সমর্থনে প্রচারে ঝড় তুলে গিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফলে বিজেপির পালে হাওয়া এখন অনেকটাই বেশি। আবার এই কেন্দ্রে ভোটের প্রচারে এসে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বারবার আবেদন শোনা গিয়েছে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শেষবারের জন্য একটা সুযোগ দেওয়ার। অর্থাৎ, তিনি যে একটা চোরাস্রোতের ইঙ্গিত পাচ্ছেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে। একসময় তাপস রায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। ফলে তিনি তৃণমূলের সংগঠন হাতের তালুর মতো চেনেন। তৃণমূলে তাঁর অনুগামীরা এখনও যে তাঁর সঙ্গেই রয়েছেন সেটাও বিভিন্নভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন তাপস রায়। এবার কলকাতা উত্তরে খেলা ঘোরাতে মরিয়া তিনি। বিজেপিও সর্বশক্তি নিয়ে এখানে পদ্ম ফোটাতে মরিয়া। ফলে কলকাতা উত্তরে এবার প্রথমবার জিততে চলেছে বিজেপি, এমনটাই মনে করছেন বঙ্গ রাজনীতির কারবারিরা।
Discussion about this post