উত্তরপ্রদেশের হাথরস, এই শহরের নাম বারবার ফিরে আসে খবরের শিরোনামে। ২ জুলাই এখানেই ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনা। এক স্বঘোষিত ধর্মগুরু ভোলে বাবার সৎসঙ্গ অনুষ্ঠানের শেষে হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১২১ জনের। নিখোঁজ ও গুরুতর আহতের সংখ্যা বহু। অনেকেরই কৌতুহল কে এই ভোলে বাবা? যার এক ডাকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন।
উত্তরপ্রদেশের হাথরস, যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যের এই শহর বারবার ফিরে আসে খবরের শিরোনামে। কখনও গণধর্ষণ, তো কখনও বাহুবলী নেতার কীর্তি। এবার ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনা। হাথরসের ইটা সীমান্তের কাছে রতিভানপুরে স্বঘোষিত ধর্মগুরু ভোলে বাবার আশ্রম। মঙ্গলবার সেখানেই জড়ো হয়েছিলেন ৫০ হাজারের বেশি ভক্ত। জানা যাচ্ছে, অনুষ্ঠান শেষে ধর্মগুরুর আশির্বাদ এবং মন্ত্রপুত জল নেওয়ার জন্য শুরু হয় হুড়োহুড়ি। অত্যন্ত অপ্রসস্ত জায়গায় মুহুর্তে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এবং পদদলিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য ভক্তের। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দাবি, বুধবার সকাল পর্যন্ত ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের তালিকায় বহু নারী এবং শিশুও রয়েছে। ঘটনার পর থেকেই পলাতক ভোলে বাবা। উল্কার গতিতে উত্থান হওয়া জনপ্রিয় এই ধর্মগুরু ভোলে বাবা আসলে কে? তাঁর পরিচয় এবং কীর্তিও কম ঘটনাবহুল নয়। বেশ রঙিন তাঁর জীবনযাপণ, রীতিমতো শ্যুট-টাই পড়ে ধর্মের পাঠ শেখান এই ধর্মগুরু।
উত্তরপ্রদেশের এটাহ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পাটিয়ালি বাহাদূর নগরে জন্ম ভোলে বাবার। যদিও তাঁর পূর্বাশ্রমের নাম সুরজপাল সিং। চাষির পরিবারে জন্ম, তাই ছোটবেলা থেকে চাষবাষ করতেন বাবার সঙ্গে। তবে সুরজপালের জীবনের চাকা ঘুরতে শুরু করে ১৮ বছরের পর থেকে। তিনি উত্তরপ্রদেশ পুলিশে কনস্টেবল পদে চাকরি পান। এরপর ধীরে ধীরে পদন্নোতি হয় তাঁর। তাঁর অনুগামীদের দাবি, উত্তরপ্রদেশ ইন্টালিজেন্স ব্যুরো বা আইবি-তে হেড কনস্টেবল পদে ছিলেন তিনি। ১৮ বছর চাকরি করার পর ১৯৯০ সালে আচমকাই স্বেচ্ছাবসর নিয়ে নেন সুরজপাল। তারপর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আধ্যাত্মিক জগতে মনোনিবেশ করেন। নিজের এলাকায় অল্প অল্প করে সৎসঙ্গ আয়োজিত করতে থাকেন। নিজেকে স্বঘোষিত ধর্মগুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। নিজের নাম পাল্টে নারায়ণ সাকার হরি নাম গ্রহন করেন। কিন্তু ভক্তরা তাঁকে ভোলে বাবা বলেই ডাকতে শুরু করেন। ফলে এই নামেই তিনি বেশি পরিচিতি লাভ করেন। যদিও নিজেকে নারায়ণ তথা শ্রীহরির অবতার হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন ভোলে বাবা। পাশাপাশি ভক্তদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রদান এবং ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির পাঠ দিতে শুরু করেন তিনি। পাটিয়ালির বাহাদূর নগরেই নিজের মৃত দাদার নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করে বিরাট আশ্রম তৈরি করেন। এরপরই উল্কার গতিতে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। উত্তরপ্রদেশ ছাড়িয়ে, রাজস্থান, মথ্যপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানাতেও তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
মূলত গ্রামের গরিবগুর্বো, অশিক্ষিত, দেহাতি মানুষদের মধ্যেই ভোলে বাবার জনপ্রিয়তা বেশি। ভক্তদের কাছে নিজেকে মহাপুরুষ বোঝাতে তিনি হলেন ‘সাকার হরি’ বা ব্রক্ষ্ণাণ্ডের একমাত্র কর্তা। তফসিলি জাতি, উপজাতি দেহাতি মানুষজনদের মধ্যে নিজের গুরুত্ব বোঝাতে সবসময় তিনি স্যুটেড-বুটেড এবং নীল টাই পড়ে সৎসঙ্গে আসতেন। এটাই ছিল ভোলে বাবার আইডেনটিটি। সবসয়ম সাহেবি কেতা দেখানোর পাশাপাশি ভোলে বাবা তাঁর স্ত্রীকেও সঙ্গে রাখতেন সবসময়। সৎসঙ্গ চলাকালীন ভোলে বাবার স্ত্রী একটি বড় মাপের সিংহাসনে বসতেন, যাকে ভক্তরা মাতাশ্রী বলে ডাকতেন। নিজের এবং স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য তিনি সর্বদা কয়েকজন বাউন্সার রাখতেন। সৎসঙ্গ চলাকালীন এই বাউন্সাররাই ভোলে বাবা এবং মাতাশ্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতেন। ২০২২ সালে করোনাকালে আংশিক লকডাউনে ভোলে বাবা খবরের শিরোনামে আসেন। সেবার মাত্র ৫০ জন ভক্তকে নিয়ে সৎসঙ্গ আয়োজন করার অনুমতি নিয়ে প্রায় ৫০ হাজার ভক্তের ভিড় জমিয়েছিলেন। যা নিয়ে গোটা দেশজুড়ে বিতর্ক হয়েছিল। যদিও মিডিয়া থেকে শতহস্ত দূরে থাকতেন স্বঘোষিত ধর্মগুরু ভোলে বাবা। এবারও হাথরস পুলিশের দাবি, এত বড় মাপের ভক্ত সমাগম হবে সেটা অনুমতি নেওয়ার সময় জানানো হয়নি ভোলে বাবার ট্রাস্টের তরফ থেকে। ফলে পুলিশের তরফে সেরকম প্রস্তুতি ছিল না বলেই দাবি। যদিও ঘটনার পর থেকেই পলাতক স্বঘোষিত ধর্মগুরু ভোলে বাবা। ঘটনা গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টেও। এখন দেখার উত্তরপ্রদেশ পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কড়া ব্যবস্থা নেয় কিনা।
Discussion about this post