চায়ের দোকানের আড্ডা হোক বা উত্তপ্ত রাজনৈতিক আলোচনা, বাঙালি বিড়িতে সুখটান দেবে না এটা হতেই পারে না। আবার অনেকেই আছেন, যারা সিগারেটের বদলে বিড়িতে টান দিতেই ভালোবাসেন। কিন্তু জানেন কি বাংলার বিড়ি শিল্প এখন কার্যত ধ্বংসের মুখে। বিড়ি শ্রমিকদের একটা বড় অংশ জানাচ্ছেন, উৎপাদন খরচের ভারে ধুঁকছে বাংলার বিড়ি শিল্প।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার দাবি করেছেন, বিড়ি তৈরির মূল কাঁচামাল কেন্দু পাতার সহায়ক মূল্য বাড়াবেন। উল্টে যাদের সহায়ক মূল্যে কেন্দুপাতা কেনার কথা, জঙ্গলমহলের সেই সমবায়গুলি কোনও এক অজানা কারণে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক। বিরোধীদের দাবি, শাসকদলের মদতপুষ্ট ফড়ে বা ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই বন্ধ হচ্ছে সমবায়গুলি। ফলে বাধ্য হয়েই কেন্দুপাতা সংগ্রহকারীরা কমদামে বিক্রি করছেন ওই ব্যবসায়ীদের কাছে। আর সেই সমস্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা চড়া দামে কেন্দুপাতা বিক্রি করছেন বিড়ি কারখানাগুলিতে। এমনকি ভিন রাজ্য থেকে কেন্দুপাতা কিনে বিড়ি শিল্প চালাতে হচ্ছে বলে দাবি করছেন অনেকে।
জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় পাওয়া যায় কেন্দুপাতা। জঙ্গল থেকে কেন্দুপাতা সংগ্রহ করাই মূল পেশা জঙ্গলমহলের আদি বাসিন্দাদের। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে কেন্দুপাতা সংগ্রহকারীদের আর্থিক অবস্থা সঙ্গীন হচ্ছে। কারণ, ন্যায্যমূল্যে কেন্দুপাতা কিনে নেওয়ার যে সমবায়গুলি স্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে অধিকাংশ বিগত এক দশকে বন্ধ হয়েছে। কেন বন্ধ হয়েছে তার জবাবও নেই। সরকারি অর্থের সাহায্যে এই সমবায়গুলি বছরের নির্দিষ্ট সময় কেন্দু গাছ কাটিংয়ের কাজ করত। নিয়মিত গাছ কাটিং হওয়ায় ভালো পাতা উৎপন্ন হতো। আর সেই পাতা সংগ্রহ করেই বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া জেলার বিড়ি কারখানা পাঠানো হতো। আবার বাংলার অনেক পরিবার খোলা বাজার থেকে এই কেন্দুপাতা কিনে নিজেদের বাড়িতেই বিড়ি তৈরি করে কারখানায় সাপ্লাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বোঝাই যাচ্ছে, কেন্দুপাতা সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিড়ির বিপনন পর্যন্ত রাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষ জড়িত রয়েছেন। অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্টভাবে কেন্দুপাতা সংগ্রহের জন্য গঠিত সমবায় ‘ল্যাম্পস’-গুলির পরিচালন সমিতির নির্বাচন না হওয়ায় তৈরি হয়েছে জটিলতা। ফলে ধীরে ধীরে কাজ বন্ধ করেছে একেকটি ল্যাম্পস সমবায়। অপরদিকে জঙ্গলমহলে কেন্দু গাছ নিয়মিত কাটিং না হওয়ায় ভালো মানের কেন্দুপাতা পাওয়া যাচ্ছে না। জঙ্গলমহলে অধিকাংশ সমবায় নিষ্কৃয় থাকায় সরকারি সহায়কমূল্যে কেন্দুপাতা বিক্রি করে দাম পাচ্ছেন না স্থানীয় অধিবাসীরা। ফলে অনেকে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকেছেন। অনেকে কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। সবমিলিয়ে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বিড়ি বাঁধাই শিল্পে। কাঁচামালের অভাবে বাড়তি দাম দিয়ে ভিনরাজ্য থেকে কিনতে হচ্ছে বিড়ি কারখানা মালিকদের। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক বিড়ি কারখানা বন্ধের মুখে।
লোকসভা ভোটের মুখে জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় এই সমস্যা শাসকদলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। বিজেপি সরাসরি দাবি করছেন, শাসকদলের মদতপুষ্ট ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই বিড়ি শিল্প ধুঁকছে। আর চরম সমস্যার মুখে পড়ছেন আদিবাসীরা। অপরদিকে, বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলির বক্তব্য, অদূর ভবিষ্যতে বাংলার বিড়ি শিল্প মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে। ফলে আগামীদিনে বিড়ির সুখটান ভুলতে হবে বাঙালিকে।
Discussion about this post