এই বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজো বলতে সকলেই এক বাক্যে চন্দননগরের নাম বলেন। কিন্তু ঐতিহ্য এবং পরম্পরা মেনে আজও কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো হয় ধুমধামের সঙ্গে। কিন্তু হুগলির চন্দননগরের সঙ্গে নদিয়ার কৃষ্ণনগরের পুজোর একটা পার্থক্য হয়েছে। সেটা হল, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো চারদিন ধরে হলেও কৃষ্ণচন্দ্রের শহরে মূল পুজো হয় নবমীর দিনে। অর্থাৎ একদিনেই জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করেন কৃষ্ণনগরবাসী। কৃষ্ণনগরে যেমন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবাড়ির পুজো রয়েছে, তেমনই রয়েছে চাষাপাড়ার বিখ্যাত বুড়িমার পুজো। আজ আমরা জানাবো কৃষ্ণনগরের বুড়িমার ইতিহাস।
কৃষ্ণনগরবাসীর কাছে বুড়িমা খুবই জাগ্রত। আর সেই থেকেই বুড়িমার মহিমা রাজ্য ছাড়িয়ে দেশ ও বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষ্ণনগরে আসেন বুড়িমার কাছে পুজো দিতে, মানত করতে। এই পুজোর ইতিহাস নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কবে, কিভাবে কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়েছিল, সেটা নিয়ে রয়েছে নানা গল্পগাঁথা। তার মধ্যে একটি হল, একটি সময় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজোর বিপুল ব্যয়ভার নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন। সেবারই দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন। এবং বলেন, পাশেই চাষাপাড়ায় লেঠেলরা তাঁর পুজোর আয়োজন করবেন। তিনি যেন সেখানে পুজোর অনুদান দেন।
এরপরই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র চাষাপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোয় কিছু টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু কৃষ্ণনগর চাষাপাড়ায় বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজো। রাজা অনুদান দিলেও এই পুজো ছিল সাধারণ মানুষের। ফলে সকলেরই প্রবেশাধিকার ছিল পুজো প্রাঙ্গনে। ফলে ধীরে ধীরে এই পুজোর মহিমা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। জানা যায়, কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়েছিল ১৭৭২ সালে। সেই হিসেবে এই পুজোর বয়স ২৫২ বছর। কিন্তু আজ থেকে ৭০ – ৭৫ বছর আগে চাষাপাড়ার জগদ্ধাত্রী বুড়িমা নামে খ্যাত হয়। কারণ ততদিনে ভক্তদের বিশ্বাস তৈরি হয়েছে, মায়ের কাছে কিছু চাইলে তিনি ফেরান না। পুজো দিতে হাজার হাজার ভক্ত ভিড় জমাতে শুরু করেন। যে হেতু এটি কৃষ্ণনগরের প্রাচীন বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজো, তাই মানুষের মুখে মায়ের নাম হয়ে যায় বুড়িমা।
হুগলির চন্দননগরে যেমন চারদিন ধরে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। কৃষ্ণনগরে কিন্তু একদিনের পুজো। অর্থাৎ নবমীর দিন পুজো, দশমীতে বিসর্জন। সেই মতো এবার বুড়িমাকে সাজানো হবে ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায়। প্রায় ১০ কেজির বেশি সোনার গহনায় বুড়িমা সেজে উঠবেন। এটাই এখানকার বৈশিষ্ট। ১০ নভেম্বর, রবিবার ভোররাতে দেবীর মঙ্গলঘটে জল ভরা হবে। ওই দিন ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে হবে সপ্তমী পুজো। সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে শুরু হবে অষ্টমী পুজো, ১২টায় পুস্পাঞ্জলি। দুপুর দেড়টা নাগাদ শুরু হবে নবমীর মূল পুজো। তিনটে নাগাদ বলিদান এবং পুস্পাঞ্জলি। এরপর হোমষজ্ঞ হয়ে সন্ধ্যায় হবে দেবীর আরতি। ১১ নভেম্বর, সোমবার সকাল ৮টা ৩৬ মিনিটে শুরু হবে দশমীর পুজো। ওই দিন দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ বুড়িমাকে আসন থেকে নামিয়ে নিরঞ্জনের প্রস্তুতি শুরু হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কৃষ্ণনগরে বুড়িমার বিসর্জন হয় সকলের শেষে। প্রথমে মাকে নিয়ে যাওয়া হয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে। তারপর শোভাযাত্রা করে জলঙ্গী নদীর ঘাটে। যা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান।
Discussion about this post