নাম দিয়ে যায় চেনা। সত্যিই তাই, নামকরণ অনেক ভেবেচিন্তেই করা হয়। ফলে নামেই অনেক কিছু চেনা যায় বৈকি। এই যেমন ধরুণ শহর কলকাতার কয়েকটি বাজার। যাদের আজব নামের জন্য সহজেই চেনা যায় বা মনে রাখা যায়। আসুন কলকাতা শহরের কয়েকটি বাজারের অদ্ভুত নামের কারণ সম্পর্কে কিছু জানি। বিশ্বের প্রতিটি পুরোনো শহরের মতো আমাদের শহর কলকাতারও কিছু অনন্য বৈশিষ্ট আছে। সেই নবাবী আমল থেকে ব্রিটিশদের রাজধানী হয়ে ওঠা। আবার ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহরের তকমা হারানো থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠা। কলকাতাকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। ফলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধার্মিক সব দিক থেকেই কল্লোলিনী গোটা ভারতের অন্যান্য শহর থেকে আলাদা। ৩০০ বছরের বেশি পুরোনো শহরের অলিগলিতে মিশে রয়েছে বহু বিস্মৃত ইতিহাস। বিশেষ করে শহরের রাস্তাঘাটের নামকরণ নিয়েই রয়েছে মজাদার সব ইতিহাস। নবাবি খানসামাদের নামে করা রাস্তার নামকরণ থেকে শুরু করে দর্জির নামেও কলকাতার রাস্তার নাম হয়েছে। আবার কলকাতার কয়েকটি পুরোনো বাজারের নামকরণের পিছনে রয়েছে মজার ইতিহাস। আজ বরং আপনাদের সেই ইতিহাসের ছোঁয়া দিই।
লালবাজার
ব্রিটিশ শাসকদের মূল ব্যাবসায়ীক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পাশের দীঘির ধারে জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার একটি শ্রীকৃষ্ণ মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন। যা শ্যামমন্দির নামে পরিচিত ছিল। এখানে প্রতি বছর ঘটা করে দোলযাত্রা বা হোলি খেলা হতো। দূর-দূরান্তের মানুষ এই মন্দিরে আসতেন কৃষ্ণকে আবির দিতে। হোলির পর এই দীঘির জল রঙ এবং আবিরের ফলে লাল হয়ে যেত। কালক্রমে এটি লালদীঘি নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তী কালে রাইটার্স বিল্ডিং এবং লালাদীঘির পাশে হুগলি নদীর মধ্যবর্তী অংশে ফোর্ট উইলিয়াম নির্মান করে ব্রিটিশ সরকার। একদিকে ব্রিটিশদের ব্যাবসায়ীক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং অন্যদিকে সামরিক দূর্গ ফোর্ট উইলিয়ামে প্রচুর ব্রিটিশ নাগরিক এবং সৈন সমাগম হতে শুরু করল। তাঁদের সুবিধার্থে লালদীঘির পাড়ে ব্রিটিশ শাসকরা একটি বাজার তৈরি করান। লালদীঘির নামানুসারে সেটির নাম লালবাজার রাখা হয়। আজও ওই এলাকা লালবাজার নামেই পরিচিত। যদিও কলকাতা পুলিশের সদর দফতরও এই এলাকায় তৈরি হয় সেই ব্রিটিশ আমলেই। যাকে আমরা লালবাজার নামেই চিনি।
বউ বাজার
কলকাতার পুরোনো বাজারগুলির মধ্যে অন্যতম বউবাজার। অনেকেই একে বহুবাজার বলে ডাকেন। অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে, এই বউবাজারে কি আগে বউ বিক্রি হতো? আজ্ঞে না মশাই, এই বউবাজার নামের পিছনে বউয়ের গল্প থাকলেও এখানে কোনও দিন বউ বিক্রি হয়নি। মধ্য কলকাতার পুরোনো বনেদি পরিবারগুলির মধ্যে মতিলাল পরিবার অন্যতম। এই পরিবারের প্রধান বিশ্বনাথ মতিলাল তাঁর পূত্রবধূ অর্থাৎ বৌমাকে লালাবাজার এবং বৈঠকখানা বাজারের মধ্যে একটি বাজার উপহার দিয়েছিলেন। এই বাজারটিকে তৎকালীন সময়ের মানুষজন বউবাজার বলতেন। বাংলায় ‘বউ’ এবং হিন্দিতে ‘বহু’, যার থেকেই এই নামকরণ। লোকমুখে বউয়ের বাজার থেকেই একসময় বউবাজার নাম হয়ে যায়।
বৈঠকখানা বাজার
আজ যেখানে শিয়ালদা স্টেশন দাঁড়িয়ে আছে, এককালে সেখানে বেশ কয়েকটি গাছ ছিল। এরমধ্যে একটি বিশাল বটগাছ আলাদা করে সকলের নজর কেঁড়ে নিত। সেই বটগাছের নীচে অনেকেই বিশ্রাম নিতেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে যারা গরুর গাড়িতে কলকাতায় পণ্য নিয়ে আসতেন বিক্রির উদ্দেশ্যে, তাঁরা এই বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতেন। কালক্রমে ওই বটগাছ ব্যবসায়ীদের বৈঠকী আড্ডায় পরিনত হয়। এমনকি জব চার্ণকও ওই বটগাছের নীচে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বহুবার। এরপর ওই এলাকায় ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বসবার ঘর তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সেখানে ব্রেড অ্যান্ড চিজ নামে একটি সরাইখানাও তৈরি হয়। ধীরে ধীরে এই এলাকায় বাজার তৈরি হয়ে যায়। বৈঠক এবং খানাপিনার জায়গা থেকে যা লোকমুখে বৈঠকখানা বাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। জানা যায়, শিয়ালদা স্টেশন তৈরি করার সময় ওই বটগাছ কেটে ফেলা হয়। শিয়ালদা স্টেশন ১৬০ বছরের বেশি প্রাচীন, ফলে বুঝে নিন বৈঠকখানা বাজার কতো পুরোনো।
Discussion about this post