মহাষষ্ঠীতে বেলতলায় দেবীর বোধন এবং অধিবাস। এরপর নবপত্রিকা বা কলাবউ স্নান করিয়ে দেবীর পাশে বসানোর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজো। এই নবপত্রিকা বা কলাবউ নিয়ে নানান মত চালু আছে। অনেকেই তাঁকে গণেশের বউ মনে করেন। কিন্তু আসল সত্যিটা কি, কেনই বা নবপত্রিকা বসানো হয় দুর্গাপ্রতিমার পাশাপাশি। দুর্গাপুজোয় নবপত্রিকার মাহাত্ম্য কি, এই ধরণের নানান প্রশ্ন আসে আমাদের মনে। আসুন এই প্রতিবেদনে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
দুর্গাপুজো চারদিনের পুজো। প্রতিদিনের পুজোর আলাদা আলাদা রীতি, আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়। তবে মূলত সপ্তমীর দিন ভোরবেলা নবপত্রিকা স্নান করিয়ে নিয়ে আসা হয় মূব মণ্ডপে। বসানো হয় ঠিক গণেশমূর্তির পাশেই। তাই অনেকেই একে গণেশের বউ ভেবে ভুল করেন। কিন্তু আপনি যেনে অবাক হবেন, এই নবপত্রিকাকেই আসল দুর্গা হিসেবে পুজো করা হয়। নবপত্রিকা কিন্তু নতুন পাতা নয়, বরং নয়টি বিশেষ গাছের পাতা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। যেমন, কলা, অপরাজিতা, হলুদ, বেল, জয়ন্তী, দাড়িম বা ডালিম, অশোক, মানকচু এবং ধান।
এই নয়টি গাছের পাতা একটি স্বপত্র কলা গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। তাতে একজোড়া বেল দিতে হয়। সবমিলিয়ে এটি নারীমূর্তির প্রকাশ পায়। নবপত্রিকায় নয়টি গাছের পাতা কিন্তু দুর্গার নয়টি রূপের প্রতীক। ফলে প্রতিটি পাতার জন্য আলাদা আলাদা মন্ত্রও রয়েছে। সেই মন্ত্রপাঠের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি পাতা এবং একজোড়া বেল স্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বাঁধতে হয়। গঙ্গা বা যে কোনও জলাশয়ে নবপত্রিকা তৈরি করে তাঁকে প্রথমে জলশঙ্খ দিয়ে স্নান করানো হয়। এরপর একটি লাল পার সাদা শাড়ি পড়িয়ে বধূর আকার দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে সিঁদুর পরিয়ে সপরিবার দুর্গাপ্রতিমার ডান দিকে গণেশের ঠিক পাশেই বসানো হয়। যেহেতু কলা গাছ দিয়েই নবপত্রিকা তৈরি হয়, তাই একে কলাবউ বলে ডাকা হয়।
এবার জেনে নেওয়া যাক নবপত্রিকার নয়টি পাতার মাহাত্ম্য কি। দেবী দুর্গার নয়টি রূপের কল্পনা রয়েছে। যা নবদুর্গা হিসেবে পরিচিত। দুর্গার নয়টি রূপ হল, ব্রক্ষ্ণাণী, কালী, উমা, কার্তিকী, শিবা, রক্তদন্তিকা, শোকারহিতা, চামুণ্ডা, এবং লক্ষ্মী। নবপত্রিকায় থাকা কলা বা রম্ভা হল ব্রক্ষ্ণাণীর প্রতীক। হলুদ বা হরিদ্রা হল উমার প্রতীক, কচু হল কালী বা কালিকার প্রতীক, জয়ন্তী হল দেবী কার্তিকীর প্রতীক। বেল বা বিল্বপত্র হল শিবার প্রতীক, দাড়িম বা ডালিম হল রক্তদন্তিকার প্রতীক। অশোক গাছের পাতা দেবী শোকরহিতার প্রতীক। মানকচূ দেবী চামুণ্ডার প্রতীক এবং ধানের শিষ হল লক্ষ্ণীর প্রতীক। এই নয় দেবী একত্রে নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা নামে পুজিতা হন।
মণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর পুজোর প্রতিদিন এই নবপত্রিকাকেই মা দুর্গা রূপে পুজো হয়। তবে নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে দেবী চামুণ্ডার আবাহন এবং পুজো করা হয়। নবপত্রিকার মধ্যে থাকা একমাত্র দেবী চামুণ্ডার পুজোই হয়। দুর্গাপুজোয় কলাবউের সাজ অনেকটাই যেন আটপৌড়ে বাঙালি বাড়ির বউয়ের মতো। তবে কলাবউয়ের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব যেমন আছে, তেমনই আছে সামাজিক গুরুত্ব। নয়টি গাছের পাতা যেমন একেকটি দেবীর স্বরূপ, তেমনই গাছ থেকেই জীবকূল যাবতীয় পুষ্টি এবং বেঁচে থাকার অক্সিজেন পায়। তাই প্রাচীন কাল থেকেই গাছকে মাতৃরূপে পুজো করা হয়। দুর্গাপুজোর মূল আচারেও এই রীতির অন্যথা হয়নি।
Discussion about this post