পশ্চিমবঙ্গের ব্যস্ততম রেলস্টেশনগুলির অন্যতম শিয়ালদহ। যাকে নিত্যযাত্রীরা সংক্ষেপে শিয়ালদা বলে থাকেন। শহরের নাম কলকাতা হলেও মূল রেলস্টেশনটির নাম শিয়ালদহ হল কেন? যেখানে দেশের বড় শহরগুলির মূল রেলস্টেশনের নাম সেই শহরের নামেই রয়েছে। যেমন নিউদিল্লি, মুম্বই সেন্ট্রাল, লখনউ, চেন্নাই ইত্যাদি। কলকাতা শহরে অবস্থিত মূল রেলস্টেশনের নাম শিয়ালদহ। অনেকেই জানেন না শিয়ালদহ স্টেশনের ইতিহাস। আসুন এই প্রতিবেদনে সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাক। যদিও বর্তমানে চিৎপুর অঞ্চলে কলকাতা নামে একটি স্টেশন চালু হয়েছে।
কলকাতার ইতিশ্বাস খুবই প্রাচীন। ব্রিটিশ বণিকরা যখন সবে ভারতবর্ষে এসেছে বাণিজ্য করতে। সেই ১৭১৭ সালে ইংরেজি বণিকরা তৎকালীন মুঘল সম্রাট ফারুখখিয়িযার কাছ থেকে ৩৮টি গ্রামের জায়গির লাভ করেন রাজস্ব আদায়ের জন্য। এই ৩৮টি গ্রামের ৫টি ছিল হুগলিতে যা বর্তমানে হাওড়া জেলায় পড়ছে। আর বাকি ৩৩টি গ্রাম ছিল গঙ্গার পূর্ব পাড়ে বর্তমান কলকাতার আশেপাশে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৮ সালে মীরজাফরের থেকে এই গ্রামগুলিই কিনে নিয়েছিল। এই ছিল কলকাতা শহর তৈরির মূল পরিকল্পনা। তবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে, সেই ১৬৯০ সালে যখন সুতানুটি নামের প্রথম গ্রামটি দখল নিয়েছিল ব্রিটিশরা। সেই সময়েই জব চার্ণক সুতানুটি গ্রামে বসে কলকাতা শহর তৈরির পরিকল্পনা করেন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এখানে পাকাপাকি বসতি গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক তথা সাহিত্যিক হ্যারি কটন তাঁর লেখা বিখ্যাত বই ‘Calcutta : Old & New”-এ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন কলকাতা শহর তৈরির পরিকল্পনার ইতিহাস। তিনি লিখেছেন, বেশ ছড়ানো ও মহান একটি পিপুল গাছের ছায়ায় বসে হুঁকোয় টান দিতেন জব চার্ণক। তাঁর বর্ণনা অনুসারে সেই বিশাল পিপুল গাছটি ছিল বর্তমানে বউ বাজার স্ট্রিট এবং লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে। যেখানে এখন স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে শিয়ালদহ স্টেশন। ১৭৯৪ সালে প্রনিত এ আপজন সাহেবের কলকাতার মানচিত্রে স্থান পেয়েছিল সেই বিখ্যাত পিপুল গাছ। হ্যারি কটন শিয়ালদহ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ১৭৫৭ সালে এই এলাকায় ছিল একটি উঁচু বাঁধানো পথ, যা পুব দিক থেকে এসেছে। চারিদিকে জলাভূমি পরিপূর্ণ উঁচু জায়গা বা জমি ঘিরে ছিল বসতি। কটন সাহেব এই এলাকার নাম লিখেছিলেন “শিয়াল ডিহি”। এখানে ডিহি অর্থে গ্রাম বোঝানো হয়েছে। কোনও কোনও ঐতিহাসিক লিখেছেন, এই জলাভূমি অঞ্চলের চারিদিকে শিয়াল ডাকতো, আর মধ্যেখানের উঁচু জায়গায় ছিল মনুষ্য বসতি। সেখান থেকেই এই স্থানের নামকরণ “শিয়াল ডিহি”। কেউ কেউ এই স্থানকে সৃগাল দ্বীপ বা জ্যাকেল আইল্যান্ড বলে চিহ্নিত করেছেন। কালক্রমে এই শিয়াল ডিহি লোকমুখে হয়ে গিয়েছে শিয়ালদহ বা শিয়ালদা। কলকাতা শহরের ইতিহাস লেখা বিখ্যাত ঐতিহাসিক পি থাম্পক্কন নায়ার লিখেছেন, শিয়ালদহ নামের সূত্রপাত সম্ভবত সেই সময় থেকে, যখন এই অঞ্চল ছিল জলাভূমি, আর মধ্যে মধ্যে গজিয়ে ওঠা কয়েকটা দ্বীপ। প্রায় জনমানব বর্জিত এই অঞ্চলে প্রচুর শিয়াল ছিল। ফলে এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল শিয়াল ডিহি।
কটন সাহেব পরবর্তী সময় লিখেছেন, তাঁর কলকাতায় থাকাকালীন শিয়ালদা ছিল ব্রিটিশ ইস্টর্ন ইন্ডিয়া স্টেস্ট রেলওয়ে লাইনের শেষ স্টেশন। মূলত দার্জিলিং থেকে চা পাতা এবং পূর্ব বঙ্গ থেকে পাট ও তামাকজাত দ্রব্য পরিবহন করার জন্য এই রেললাইন পেতেছিল ব্রিটিশরা। এছাড়া একটি লাইন বেলিয়াঘাটা সল্টলেক বন্দর পর্যন্ত গিয়েছিল। সে সময়ে শিয়ালদা স্টেশন ছিল টিনের চাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা ভবন। পরবর্তী সময়ে ১৮৬২ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে শিয়ালদা থেকে কুষ্ঠিয়া পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ শেষ করে। পড়ে তা গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এবং ১৮৬৯ সালে শিয়ালদা স্টেশনে পাকা বিল্ডিং নির্মিত হয়।
Discussion about this post