২০০৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, বাংলার দুরারে তখন দুর্গাপুজো। দেবীপক্ষের সূচনা হয়ে গিয়েছে। কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন স্বয়ং রতন টাটা। যদিও ততদিনে সিঙ্গুরের ন্যানো গাড়ির কারখানা নিয়ে চরম অনিশ্চিয়তার কথা বাংলার জনগণ জেনে গিয়েছেন। সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা নিয়ে বাংলার জনগণ তখন কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। ঠিক সেই সময়ই রতন টাটা সাংবাদিক সম্মেলন থেকে জানিয়ে দিলেন সিঙ্গুর থেকে ন্যানো কারথানা গুটিয়ে নিয়ে গুজরাটে চলে যাচ্ছে টাটা মোটরস। এরপর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ ১৬ বছর। কিন্তু কি অদ্ভুত সমাপতন দেখুন সেই দুর্গাপুজোর মুখেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন ৮৬ বছরের রতন টাটা। আর তাঁর একমাস আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সেই বাম আমলের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বাংলার শিল্প মানচিত্রে এক নতুন অধ্যায় স্থাপনের স্বপ্ন দেখানো দুই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষই প্রায় এক সঙ্গেই বিলীন হলেন। কিন্তু হুগলির সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানার জমি এখনও পড়ে রয়েছে সেই অন্ধকারেই। আসলে বিতর্ক কখনও মরে না, বারবার ফিরে ফিরে আসে।
রতন টাটার মৃত্যুর পর আবার সিঙ্গুরের জমি নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। এমনিতেই আর জি কর কাণ্ডে উত্তাল রাজ্য রাজনীতি। এই আবহেই এবার সিঙ্গুরের ক্ষোভে ঘি ঢাললেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। ১৮ অক্টোবর, শুক্রবারই তিনি সিঙ্গুরে করলেন বিশাল মিছিল। সদ্য প্রয়াত রতন টাটার স্মরণে সিঙ্গুরে মিছিল করার পর টাটাদের ছেড়ে যাওয়া প্রকল্প এলাকার দ্বিতীয় গেটের কাছে করলেন এক জনসভা। সেখান থেকেই তিনি ঘোষণা করলেন, এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে টাটাদের হাতে পায়ে ধরে ফিরিয়ে আনা হবে সিঙ্গুরের মাটিতে।
প্রসঙ্গত, সিঙ্গুর থেকে টাটাদের বিদায়ের সময় এই শুভেন্দু অধিকারীই ছিলেন তৃণমূলের প্রথমসারির নেতা। তৎকালীন সিঙ্গুর আন্দোলনে তাঁকে সবসময়ই দেখা গিয়েছিল তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশেপাশে। কিন্তু এখন তিনি তৃণমূলের সঙ্গ ছেড়ে পুরোদস্তুর বিজেপি নেতা। রাজ্যের বিরোধী দলনেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। এই আবহে শুভেন্দু অধিকারী নতুন করে সিঙ্গুর আন্দোলন খুঁচিয়ে তোলায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে শাসকদল। যদিও তৃণমূলের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। আর সেই আন্দোলনে শুভেন্দুও ছিলেন মমতার ছায়াসঙ্গী। ফলে তৎকালীন সিঙ্গুর আন্দোলনে শুভেন্দুর ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তৃণমূল তাঁকে বিঁধেছে। অপরদিকে, সিপিএমও শুভেন্দু অধিকারীকে বিঁধতে ছাড়েনি। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, রতন টাটার মৃত্যুর পর নতুন করে সিঙ্গুর প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তুলে বিজেপি কি ফায়দা লুঠতে পারবে?
রাজনৈতিক ওয়াকিবহার মহলের মতে, শুক্রবার সিঙ্গুরে শুভেন্দু অধিকারী কার্যত নতুন করে সিঙ্গুরের জমিদাতা এবং বঞ্চিত কৃষকদের ক্ষোভে ঘি ঢালার চেষ্টা করলেন। এবার দেখতে হবে সেই ক্ষোভের আগুন উস্কে কতটা শিখা ওঠাতে পারে বিজেপি। কাশফুলে ভরা পরিত্যক্ত টাটা প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে শুভেন্দু বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডিনামাইট দিয়ে টাটার কারখানা গুঁড়িয়ে দিলেন! না শিল্প হল, না চাষাবাদ”। সিঙ্গুরের মাটিতে দাঁড়িয়েই বিরোধী দলনেতা সুকৌশলে খুঁচিয়ে তুললেন রাজ্যের শিল্পায়নের চিত্র। তিনি বলেন, একমাত্র শিল্পায়নই পারে কোনও রাজ্যের কোষাগার ভরিয়ে তুলতে। আর তাতে লক্ষ্ণীর ভাণ্ডারের টাকা বা অন্যান্য ভাতার টাকা দ্বিগুণ ও তিনগুণ করা যায়। আবার বেকার সমস্যার সমাধানও সম্ভব। এদিন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে শুভেন্দু সেই সময়ে তাঁর অবস্থানের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে ধর্মতলায় মমতা যে অনশন-অবস্থান করেছিলেন, তার সঙ্গে দূরত্ব বোঝাতে গিয়ে শুভেন্দু বলেছেন, “একমাত্র আমিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চকলেট-স্যান্ডউইচ খাওয়া অনশনে যাইনি। কারণ, মন থেকে সিঙ্গুরে টাটার বিরোধিতা করতে পারিনি”। এরপরই তিনি মাস্টারস্ট্রোক দিয়ে বলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে টাটাদের হাতে পায়ে ধরে সিঙ্গুরে ফেরাবো।
সিঙ্গুরে আদৌ টাটা গোষ্ঠী ফিরবে কিনা সেটা সময় বলবে। তবে রতন টাটার মৃত্যুর পর তাঁরই স্বপ্নের প্রকল্পের কঙ্কালের উপর দাঁড়িয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতার আর্তি বাংলার রাজনীতিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করতে চলেছে এ কথা বলাই বাহুল্য। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমির বেশিরভাগটা এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে না হয়েছে শিল্প, না হচ্ছে কৃষিকাজ। ফলে সিঙ্গুরের কৃষকদের একটা বড় অংশ এখন ক্ষুব্ধ। আবার টাটাদের মতো প্রতিষ্ঠানের রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ায় বাংলার বেকার যুবসমাজের একটা বড় অংশও ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে বিজেপি যদি সিঙ্গুর আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, তবে লাভ তাঁদেরই।
Discussion about this post