একদিকে শিক্ষিত সমাজের কান্না, বাতিল হয়েছে প্রায় ২৬ হাডার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্যানেলের ওপরও ঝুলছে খাড়া। অন্যদিকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের অনুদান দ্বিগুণ করতে চলেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৬-এর হাই ভোল্টেজ ভোটে কতটা প্রভাব পড়বে শাসক দলের এই দান-ধ্যানের রাজনীতি?
মঙ্গলবার মেদিনীপুর কলেজ মাঠের প্রশাসনিক সভা থেকে চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কর্মস্থলে ফেরার আর্জি জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর এই আর্জির মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিও ছিল এক আশ্চর্য চ্যালেঞ্জ। রাজ্যে এক ধাক্কায় প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। মূল অভিযোগ দুর্নীতি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেটা মানতে নারাজ। তাঁর প্রতিটি বক্তব্যেই সুর এক। সেটা হল যারা আদালতে গিয়েছিলেন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁরাই এই চাকরি বাতিলের জন্য দায়ি। অথচ তিনি একবারও স্বীকার করছেন না যে দুর্নীতি হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। যে কারণে এখনও জেলবন্দী রাজ্যের পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী-সহ বহু শিক্ষা কর্তা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবখানা এমন করছেন, তিনিই শিক্ষকদের বেতন দেন। তাই এসএসসি ভবনে অবস্থান না করে সকলে কাজে যোগ দিন। তাঁর কথায়, “আমি মেদিনীপুরে রয়েছি, না হলে কলকাতায় থাকলে ১ সেকেন্ডে মিটিয়ে দিতে পারতাম”।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় প্রতিটি সভা-সমাবেশে নিয়ম করে বিরোধিদের তোপ দেগে চলেছেন। ২৬ হাজার চাকরি বাতিল নাকি বিরোধিদের চক্রান্ত। অথচ, রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশন যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের তালিকাই প্রকাশ করতে পারছে না। সোমবার সন্ধ্যেবেলা থেকে হাজার হাজার চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকা সল্টলেকে এসএসসি ভবনের সামনে ধরণা দিয়ে বসে আছেন। সারারাত তাঁরা সেখানে ছিলেন। অভিযোগ, মহিলা ও পুরুষদের কোনও শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই, পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করাই যায়, প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেবে না?
আগামী বছরই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে আর জি কর কাণ্ড কোনওমতে ধামাচাপা দিতে পারলেও তৃণমূল কংগ্রেস শিক্ষকদের এই আন্দোলন ধামাচাপা দিতে পারবে না সহজে। কারণ, শীর্ষ আদালতেও দুর্নীতি প্রমানিত। যতই রিভিউ পিটিশন দাখিল করুক রাজ্য সরকার। যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা না করতে পারলে সঠিক ন্যায় দেওয়া সম্ভব নয়। আর এটা একমাত্র রাজ্য প্রশাসন বা এসএসসি করতে পারে। ফলে প্রবল চাপের মুখে পড়েছে তৃণমূল সরকার। শীর্ষ আদালত আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। তার মধ্যে নতুন নিয়োগ করতে হবে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটা রাজ্য প্রশাসনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতিতে দাবি উঠছে লক্ষ্ণীর ভাণ্ডারের অনুদানের অর্থ বাড়িয়ে দেওয়া হোক। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এই লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার প্রকল্পের জন্যই ২০২১ সালের নির্বাচনে বাজিমাত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি হিসেব বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার প্রকল্পে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। বর্তমানে ‘স্বাস্থ্য সাথী’-তে তালিকাভুক্ত ২৫-৬০ বছর বয়সী মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য, এসসি/এসটি পরিবারের মহিলা সদস্যদের প্রতি মাসে ১,২০০ টাকা এবং অন্যান্য সুবিধাভোগীদের প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলনের অভিমুখ ঘোরাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অনুদান বাড়িয়ে দিতেই পারেন। কিন্তু বিরোধিদের বক্তব্য, লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী বা রূপশ্রীর মতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যাবতীয় জনমুখী প্রকল্প ধারের টাকাতেই চলছে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি’ এক সমীক্ষা রিপোর্টে দাবি করেছে, মমতা সরকার যে সব জনমুখী প্রকল্প চালু করেছে, তার পিছনে ২০১৮-’১৯ অর্থ বছরে খরচ হত ১৩৪৫ কোটি টাকা। ২০২১-’২২-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩০২ কোটি টাকা। এবং ২০২২-’২৩ অর্থ বছরে তা এক লাফে বেড়ে ১২,৩৪৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদদের দাবি, ২০২১-’২২ অর্থ বছরে রাজ্য সরকারের ভর্তুকির বহর ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যার অর্থ ভর্তুকির সব টাকাই এসেছে ঋণ থেকে। ফলে ২০২৬ নির্বাচনের আগে লক্ষ্ণীর ভাণ্ডারের আনুদান বাড়ালে আরও বাড়বে ঋণের বোঝা। কিন্তু এবার যা ঠেলা খেতে চলেছে তৃণমূল সরকার, তাতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও বাঁচাতে পারবে কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে খোদ তৃণমূলের অন্দরে।
Discussion about this post