‘আশ্চর্য সমাপতন’! সকালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইট, বিকেলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে। দুজনের বক্তব্যের বিষয়বস্তু এক ও অভিন্ন। বরং বলা যায় অদ্ভুত তাল ও মিল রয়েছে। যা আর জি কর কাণ্ডকে অন্য সুরে বেঁধে দিল। এই নারকীয় ঘটনা নিয়ে যখন শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস পরপর প্রশ্নবানে পড়ছে। ঠিক তখনই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা চাপ তৈরির দাওয়াই বাতলে দিলেন। আর কয়েকঘন্টার মধ্যেই তৃণমূল নেত্রী সেই দাওয়াই প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দিলেন, তৃণমূল এখন কোন পথে চলবে।
আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় যখন গোটা দেশ উত্তাল, তখন আশ্চর্যজনকভাবে নিরব ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, ফলে তাঁর নিরাবতা নিয়ে শুরু হয়েছিল নানান জল্পনা-কল্পনা। অপরদিকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি আর জি কর ঘটনা নিয়ে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন। নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে সান্তনা দেওয়া হোক বা রাজপথে নেমে প্রতিবাদ মিছিল করা, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বিচার চেয়ে পথে নামেন। যা নিয়ে বিরোধীরা কম কটাক্ষ করেনি। সেখানে আর জি কর কাণ্ডের প্রথমদিকে প্রকৃত দোষীদের “এনকাউন্টার” দাবি করে আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন অভিষেক। আবার হাসপাতালে ভাঙচুর, হামলার রাতেই তাঁর টুইট বুঝিয়ে দিয়েছিল তিনি বিষয়টি হালকাভাবে নেননি মোটেই।
অপরদিকে দলের অবস্থান ছিল ভিন্ন। আর জি কর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার নিন্দা করলেও, আর জি করে হামলার ঘটনায় তৃণমূলনেত্রী সরাসরি দোষারোপ করছিলেন বিজেপি ও বামফ্রন্টকে। যা নিয়ে দলের অন্দরেই ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। মমতাপন্থী কয়েকজন সেই সুরেই বাম-রাম যোগ নিয়ে সরব হন। কিন্তু তৃণমূলের একটা অংশ প্রকাশ্যেই বলেন এটা ঠিক হচ্ছে না। আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরাবতা তাতে আরও ইন্ধন জোগায়। দলের মধ্যে কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি তোলেন অভিষেককে নিরাবতা ভেঙে সক্রিয় হতে হবে। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ প্রকাশ্যেই বলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে এগিয়ে আসা। তিনি এও দাবি করেন, এক বিশেষ কারণে অভিষেক নিষ্ক্রিয়। তবে সেই বিশেষ কারণটা কি, সেটা তিনি বলেননি। ফলে এতে আদি ও নব্য তৃণমূলের ‘দ্বন্দ্ব’ দেখতে শুরু করেন অনেকেই।
আর জি কর নিয়ে তৃণমূলের যখন প্রায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, ঠিক তখনই নিরাবতা ভঙ্গ করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দিলেন একটি মাস্টারস্ট্রোক। বৃহস্পতিবার সকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি নাতিদীর্ঘ পোস্ট শেয়ার করেন তিনি। এবার “এনকাউন্টার” তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে এসে তিনি সুকৌশলে কেন্দ্রের কোর্টেই বল ঠেলে দিলেন। ওই পোস্টে তিনি রাজ্য সরকারগুলিকে আহ্বান জানালেন কেন্দ্র সরকারকে চাপ দেওয়ার। তিনি বললেন, রাজ্য সরকারগুলির উচিত, কেন্দ্রের কাছে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ নিয়ে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানানো। যাতে ৫০ দিনের মধ্যেই প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে কঠোরতম সাজা দেওয়া যায়। বৃহস্পতিবার বিকেলেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি চিঠি লিখলেন, এমনই কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে। ব্যাপারটা এমন, যেন “চ্যারিটি বিগেনস হোম”।
ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, আর জি কর হাসপাতাল ভাঙচুরের রাতেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে একটি ‘আক্রমণাত্মক’ টুইট করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে প্রশংশিত হলেও প্রশাসনিক মহলে কোনও প্রভাব পড়েনি। এরপরও পুলিশ ও প্রশাসনের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত সরকার ও দলকে চাপে ফেলে দিয়েছিল। যা দেখে কার্যত অসন্তুষ্ট অভিষেক নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। আরেকটি বিষয়, গত ১৫ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজপথে নেমে নির্যাতিতার বিচার চেয়ে মিছিল করাও অনেকে মেনে নিতে পারেননি। যেটা সম্ভবত তৃণমূলনেত্রীও উপলব্ধি করেছিলেন। তাই এর পর থেকে তিনিও প্রকাশ্যে সেরকম কিছু বলেননি। এদিকে আর জি কর নিয়ে আন্দোলন, প্রতিবাদ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ বেড়েই চলেছে। এরকম একটা সময়ে প্রকৃত কাণ্ডারির মতোই তৃণমূলকে পথ দেখালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর জি কর ইস্যুকে কেন্দ্রের গিকে ঘুরিয়ে দিতে পাল্টা চাল দিলেন তিনি। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তৃণমূলনেত্রী। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এটা সবে শুরু।
Discussion about this post