ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি। দশ-পনেরো বছর আগেও এই জায়গাগুলির নাম শুনলে বুক কাপতো ভয়ে। এখানকার জঙ্গলে ঘাটি গেড়ে থাকতো মাওবাদীরা। ভরদুপুরেও ভারী বুটের দাপট, রাইফেল হাতে টহল দিত আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা। আর জঙ্গলের ভেতর রাজত্ব চালাতো মাওবাদীরা। জঙ্গলের মাঝে গ্রামগুলিতে ভয় কাটা হয়ে থাকতেন গ্রামবাসীরা। আর এখন সেই ঝাড়গ্রাম বেলপাহাড়ি পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য বললেও কম বলা হয়। শীতকাল হলেই খ্যাঁদারানির ধারে, ঘাঘরার পাড়ে বসে চড়ুইভাতির আসর। শুধু কলকাতা নয়, গোটা রাজ্য থেকেই সারা বছর ভিড় করেন পর্যটকরা। আজ আপনাদের বলবো এক অন্য বেলপাহাড়ির গল্প। ভরা বর্ষায় এখানে এলে আপনি হারিয়ে যাবেন প্রকৃতির এক অনন্য রূপে।
বেলপাহাড়ির আনাচ-কানাচে শাল-মহুয়ার জঙ্গলে কোথাও রয়েছে জলাধার, কোথাও সুন্দরী ঝর্ণা, কোথাও আবার প্রাগৈতিহাসিক গুহা। ফলে বর্ষায় আরও সুন্দরী হয়ে ওঠে বেলপাহাড়ি। আসলে শীতের বেলপাহাড়ি তো অনেকেই দেখেছেন। এই সময় ভিড়ও হয় অনেক। তবে ঘনঘোর বর্ষায় আকাশ মেঘে ঢাকলে সেই বেলপাহাড়ি অন্য রকম রূপে ধরা দেয়। জঙ্গল তখন ঘন সবুজ, শুকনো ঝর্নাগুলি জলে জলে ছয়লাপ। নির্জন খোলা প্রান্তর, সবুজ মাঠঘাট, শালের জঙ্গলে বৃষ্টির মেজাজ আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে। যা আপনি ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলে পাবেন না। তাই সপ্তাহান্তে সপরিবারে বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে আসতেই পারেন ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি।
আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক বেলপাহাড়িতে কি কি দেখবেন
বেলপাহাড়ি যেতে হলে আপনাকে প্রথমে পৌঁছতে হবে ঝাড়গ্রাম শহরে। সেখান থেকে বেলপাহাড়ি যাওয়ার প্রচুর গাড়ি পেয়ে যাবেন। বেলপাহাড়িতে এখন প্রচুর হোটেল, রিসর্ট ও হোম স্টে তৈরি হয়েছে পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে। প্রান্তিক এই এলাকায় ঘোরার জন্য রয়েছে অসংখ্য স্পট। প্রথমেই আসে গাড়রাসিনী পাহাড়ের নাম। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই পাহাড়, পাথুরে আঁকাবাঁকা রাস্তা। পায়ে হাঁটা পথে শান্ত নিরিবিলি জায়গায় একটি মন্দির রয়েছে। এখানে একটু জিরিয়ে নিতে পারেন। গাড়রাসিনী পাহাড়ের চূড়ায় আরেকটি মন্দির আছে। তবে আপনার পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে বর্ষার রূপ। চারিদিকে জঙ্গল সবুজে সবুজ। ইতিউটি উঁকি দিচ্ছে পাহাড়ি ঝর্ণা। আর মেঘের ঘনঘটা হলে তো কথাই নেই।
এরপর চলে আসুন বেলপাহাড়ি থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে ঘাঘরা জলপ্রপাত দেখতে। বর্ষায় এর রূপ অতি ভয়ঙ্কর হয়েছে ওঠে। অদ্ভূত পাথুরে ভূ-প্রকৃতি এখানকার। ভরা বর্ষায় যখন এখান থেকে জলের ধারা প্রবাহিত হয়, তখন শব্দের একটা অদ্ভুত তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। শীতকালে এই ঘাঘরা জলপ্রপাতের আশেপাশে অনেকে আসেন পিকনিক করতে। কিন্তু ভরা বর্ষায় এর অন্য রূপ। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে যখন প্রবল শব্দে জল বয়ে যায়, ঘাঘরা জলপ্রপাতের সেই রূপের আকর্ষণই আলাদা। ঘাঘরার কাছেই রয়েছে তারাফেনি জলাধার। চারিদিকে সবুজের মাঝে টলটলে জলের এই লেক দেখতে বেশ লাগে।
অপরদিকে পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে রয়েছে ঢাঙিকুসুম গ্রাম। বেলপাহাড়ি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে সবুজে ঘেরা ছোট্ট এই গ্রাম। শান্ত ও নির্জন ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাথরের উপর দিয়ে কুলু কুলু শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। কাছে গেলেই চোখে পড়বে ডুংরি ফলসের। কিংবা দেখতে পাবেন হদহদি ঝর্না। আপাত দৃষ্টিতে ঢাঙিকুসুম গ্রামে সেই অর্থে এখানে বেশি কিছু দেখার নেই। কিন্তু যেটা আছে, তা আপনি কলকাতায় বসে কল্পনাও করতে পারবেন না। ঢাঙিকুসুম মূলত আদিবাসীদের গ্রাম। যারা পাথর কেটে থালা-বাটি-বাসন এবং আরও নানা জিনিসপত্র তৈরি করেন। সেও এক দেখার মতো ব্যাপার। আর বৃষ্টিভেজা ঘন জঙ্গলে ইতিউতি হেঁটে বেড়ানো। বর্ষার জলে পুষ্ট ডুংরি ফলসের সৌন্দর্য বা হদহদি ঝর্নার কলকলানি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। দিনের শেষে ঘুরে আসুন খ্যাঁদারানি লেকের ধারে। কেন এমন নাম কে জানে! তবে পড়ন্ত বিকেলে খ্যাঁদারানির সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেবে। বর্ষায় এখানকার সৌন্দর্য আবার অন্যরকম। এই লেকের পাশেই রয়েছে একটি কংক্রিটের সেতু। সেখান থেকেই সবুজে মোড়া পাহাড়ের কোলে বিস্তীর্ণ খ্যাঁদারানির সৌন্দর্য দেখা সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। সময় করে ঘুরে আসুন চাতন পাহাড়ে। এখানেই আছে প্রাগৈতিহাসিক আমলের লালজল কেভ বা গুহা। এগুলি প্রাকৃতিক গুহা হলেও এর প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বেলপাহাড়ি থেকে কাঁকড়াঝোরের দিকে যাওয়ার পথ শালবনের পাহাড়ি পথে ২০০ মিটার উঠলেই দেখবেন আদিম তিন গুহা। সেখান থেকে চারপাশের নিসর্গ মন ভাল করে দেবে আপনার।
কলকাতা থেকে অনেকগুলি বাস ছাড়ে ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে। এছাড়াও হাওড়া থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেন পেয়ে যাবেন। এরমধ্যে হাওড়া-বড়বিল জন শতাব্দী এক্সপ্রেস, ইস্পাত এক্সপ্রেস, ঘাটশিলা মেমু সবচেয়ে ভালো। তাই আর দেরি নয়, সপ্তাহান্তে দুদিনের ছুটি কাজে লাগিয়ে এই বর্ষায় বেলপাহাড়ি ঘুরে আসুন। আর আপনারা কোথায় কোথায় যেতে চান কমেন্ট করে জানান।
Discussion about this post