সামনে দিগন্ত ছাড়িয়ে চপল জলরাশি। পড়ন্ত বিকেলে সূয্যিমামা ঘরে ফেরার তোড়জোড় করছেন, মাথার উপর দিয়েছি দল বেঁধে ঘরে ফিরছে চেনা অচেনা পাখিরা। সামনেই কাঁটাতার, কিন্তু ওরা দেশ-রাজ্যের সীমানা বোঝে না, তাই অবলীলায় উড়ে যায় ভারত ছাড়িয়ে বাংলাদেশের দিকে। বাওড়ের জলে হিন্দোল তুলে একে একে ডাঙায় ফিরছে ডিঙি নৌকা। চারিদিকে শান্ত-নির্জন পরিবেশ। শুধু বাসায় ফেরার আনন্দে পাখিদের কলতান এক অশোনা অর্কেস্ট্রার মূর্ছনা বাজিয়ে চলেছে। শহর কলকাতায় থাকা শহুরে মানুষদের কাছে এই পরিবেশ একেবারেই স্বর্গ। বাংলার বুকে এমনই সব আশ্চর্য জগৎ আছে সেটা হয়তো অনেকেই জানেন না। বেড়ি পাঁচপোতা, বাংলাদেশ সীমান্তে একেবারে গা ঘেঁষে আদিগন্ত বাওর বা জলরাশি। মাঝে মধ্যে দ্বীপের মতো চরে শুধুই সবুজের আলপনা। অশ্বখুরাকৃতি একটি হ্রদ, লোকে ডাকে ‘বাওর’। যাবেন নাকি সেই বাওরে একবেলার শান্তি খুঁজতে?
বর্তমান ব্যস্ততার জীবনে অনেকেই একটু শান্তির খোঁজে ঘুরে বেড়ান কাছেপিঠের কোনও অফবিট জায়গায়। শহুরে ধোঁয়া দূষণের পরিবেশ বদলে এক বা দুইদিনের ছুটিতে ছুটে যান কোনও অজানা অখ্যাত জায়গায়। যেখানে পাওয়া যায় বিশুদ্ধ বাতাস, গ্রাম্য শান্ত জনজীবন। এরকমই একটি জায়গা হল বেড়ি পাঁচপোতা। স্থানীয় প্রবীণদের দাবি, বহুকাল আগে ইছামতি এই এলাকা দিয়েই বয়ে যেত। এরপর কালের নিয়মে পথ বলেছে ইছামতি। আর রেখে গিয়েছে এই অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ। যা স্থানীয়দের কাছে বাওর বলে পরিচিত।
জনশ্রুতি আছে আগে এখানে বন্দর বা পোতাশ্রয় ছিল। রাজা প্রতাপাদিত্য এখানে ইছামতী নদী ধরে এখানে এসেছিলেন এবং তাঁর পোত বা বাণিজ্যতরী নোঙর করেছিলেন। এই এলাকাতেই বেড়ি বাওর ছাড়াও রয়েছে ডুমোর বাওর, বলদেঘাটা বাওর, ঝাউডাঙা বাওর, ও ইছামতি বাওর। সবমিলিয়ে বেড়ি পাঁচপোতা। এপারে ভারত আর ওপারে বাংলাদেশ। ফলে নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে আপনি ওপার বাংলার গ্রামগুলির জনজীবন দেখতে পারবেন অনায়াসেই। পাশাপাশি এই এলাকায় রয়েছে একটি প্রাচীন কালীমন্দিরও। মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই আপনি পৌঁছে যাবেন বেড়ি পাঁচপোতা।
বুঝতেই পারছেন কলকাতা থেকে খুব একটা দূরে নয়। শিয়ালদা বা দমদম স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্ত লাগোয়া গোবরডাঙা পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ১ ঘণ্টা। এই গোবরডাঙার কাছেই বেড়ি পাঁচপোতার অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ। এক পলকেই প্রেমে পড়ে যাবেন এখানে এলে। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, চারিদিকে সবুজের সমারোহ। আশেপাশের গ্রামগুলিতে নৌকাই ভরসা। ফলে অসংখ্য ঘাট এবং বাড়ির উঠোনে বাঁধা ডিঙি নৌকা দেখে অনেকেই এই বেড়ি পাঁচপোতাকে আদর করে ডাকেন বাংলার আলেপ্পি। বাঙালি পর্যটক মাত্রই জানেন, কেরলের আলেপ্পি ব্যাক ওয়াটারের কথা। গোবরডাঙার বেড়ি পাঁচপোতা অনেকটা সেই আলেপ্পির মতোই। ফলে এখানকার অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ বা বাওর ঘিরে পর্যটন কেন্দ্রের সমুহ সম্ভবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই গুটিকয়েক হোম স্টে তৈরি হয়েছে বাওরকে কেন্দ্র করে। কলকাতার একটি সংস্থা সূদৃশ্য কটেজও তৈরি করেছে। ফলে উইকএন্ডে এক রাত দুইদিনের জন্য ঘুরেই আসা যায় গোবরডাঙার বেড়ি পাঁচপোতা। এলাকাবাসীর আশা রাজ্য সরকার এখানকার পরিকাঠামো উন্নয়ন করলে আগামীদিনে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠবে।
ওপারে বাংলাদেশ, এপারে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। সাড়ে সাত কিলোমিটার অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ, এবং অসংখ্য বিল। চারপাশের পরিবেশ দেখলে মনে হবে যেন বাংলার বুকে একটুকরো কেরল। স্থানীয়রা এই বাওর থেকে মাছ ধরেন। ফলে এখানে এলে টাটকা মাছের স্বাদ চেটেপুটে উপভোগ করতে পারবেন। একটু দরদাম করে উঠে পড়ুন কোনও একটি ডিঙি নৌকায়। ঘুরে দেখুন বাওরের আশেপাশের গ্রামগুলি। অদূরেই বাংলাদেশের গ্রামগুলি দেখা যায়। চাইলে ইছামতি পর্যন্ত ঘুরে আসা যায়। তবে সঙ্গে রাখতে হবে সচিত্র পরিচয়পত্র। কারণ মাঝে মধ্যে বিএসএফ তা দেখতে চাইতে পারে। বেড়ি পাঁচপোতায় দেখে নিতে পারেন অতি প্রাচীন এক কালী মন্দির এবং স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশন। ফলে ইউটিউব এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ভ্লগারদের কাছে স্বর্গরাজ্য হতে পারে বেড়ি পাঁচপোতা। এছাড়া রোমান্টিক পরিবেশের মধ্যে প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে নৌকাবিহার আপনাকে নিরাশ করবে না।
কিভাবে যাবেন?
শিয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেনে গোবরডাঙা ঘণ্টা দেড়েক এবং দমদম স্টেশন থেকে ঘণ্টাখানেক। চারচাকা গাড়ি নিয়েও গোবরডাঙা সহজে যাওয়া যায়। গোবরডাঙা স্টেশন থেকে অটো, টোটো বা ম্যাজিক গাড়ি পেয়ে যাবেন। রিজার্ভ করেও যাওয়া যায়। নামতে হবে পাঁচপোতা বাজারে। এখান থেকে হাঁটা পথে বাওরের কোনও এক ঘাটে চলে আসুন।
Discussion about this post