পশ্চিমবঙ্গের মতোই ওপার বাংলা তথা বাংলাদেশের হিন্দুদের কাছে সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। কিন্তু মাস দুই আগেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে। এরপরই সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে আবহ। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নেমে এসেছে হামলার খাঁড়া। একের পর এক হামলা, মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ। এতকিছুর পরও তাঁরা দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
সেখানেও বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন হিন্দুরা। বেশ কয়েকটি কট্টরপন্থী সংগঠন নানারকম ফতোয়া জারি করে, হুমকি দিয়ে পুজো বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। ফলে এবার বাংলাদেশে দুর্গাপুজো নিয়ে তৈরি হয়েছিল আশঙ্কার কালো মেঘ। এই আবহেই ভারত সরকার সরাসরি বাংলাদেশের তদারকি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে গিয়েছে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ভারত সফল দৌত করে। ফলে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এবং আমেরিকা বাংলাদেশের তদারকি সরকারকে চাপ দেয় সে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বার্থরক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে। ফলে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে তদারকি সরকার কড়া হাতে পুজো পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফলে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত হামলার ঘটনা ছাড়া বাংলাদেশে এবারের দুর্গাপুজো নির্বিঘ্নেই কাটল।
বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদ বা বিপিইউপি প্রতি বছরই ভারতের পড়শি দেশের দুর্গাপুজো পরিচালনা করে। এবারও তাঁরা দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু করেছিল বহুদিন আগে থেকেই। কিন্তু এরমধ্যেই বাংলাদেশ উত্তাল হয় কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। যা ক্রমশ রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। যার ফলস্বরুপ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয়। এরপরই পাল্টে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল।
কট্টরপন্থী মৌলবাদী সংগঠনগুলি নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। শুরু হয় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের উপর হামলা। যা নিয়ে প্রথম থেকেই সরব হয়েছিল নয়া দিল্লি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরেই সংখ্যালঘু এবং হিন্দুদের উপর অত্যাচার বেড়েছে বলে দাবি করা হচ্ছিল নানা মহলে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন তদারকি সরকার বারবার আস্বস্ত করলেও হামলার ঘটনা ঠেকাতে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থও হয়। এরপর ভারত-সহ পশ্চিমী দেশগুলির চাপে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের তদারকি সরকার। বাংলাদেশের সেনা প্রধান ওয়াকার উজ জামান আশ্বস্ত করেছিলেন পুজোয় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। ফলে এবার বাংলাদেশের দুর্গাপুজো মোটের ওপর নির্বিঘ্নেই কাটল।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি দুর্গাপুজো হয়। বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদ জানিয়েছে, এবার ঢাকায় মোট ২৫৭টি দুর্গাপুজো হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল, ঢাকা মহানগর সর্বজনীন, সিদ্ধেশ্বর বাসুদেব মন্দির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, গুলশন-বনানী পুজো মণ্ডপ, কামার বাড়ি পুজো মণ্ডপ, শাখাঁরিবাজার, সিদ্ধেশ্বরী সর্বজনীন, তাঁতিবাজার, ঢাকেশ্বরী সর্বজনীন, ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠের পুজোগুলি। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লের উপাশনালয় এবং ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ আশ্রমে। প্রতি বছর ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠে কুমারী পুজো হয়, কিন্তু এবারের অশান্তির আবহে কুমারী পুজো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রামকৃষ্ণ মঠ। তবে তদারকি সরকারের অনুরোধে এবং আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত কুমারী পুজো হয়েছে।
পাশাপাশি মণ্ডপে মণ্ডপে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস ও উদ্দিপণা সত্যিই ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকার বেশ কয়েকটি মণ্ডপের আলোকসজ্জাও নজর কেড়েছে এবার। প্রতিটি মণ্ডপেই বাংলাদেশের পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর নজরদারি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবুও বাংলাদেশে দুর্গাপুজোয় ৩৫টি মণ্ডপে অশান্তি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি মহম্মদ ময়নুল ইসলাম। তিনি জানান, সারা দেশে ৩২ হাজারের বেশি দুর্গাপুজো হয়েছে। এরমধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি জায়গা থেকে অশান্তির খবর এসেছে। আমরা কড়া ব্যবস্থা নিয়েছি। সবমিলিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকারের আমলে বাংলাদেশের প্রথম দুর্গাপুজো ভালোয় ভালোয় মিটেছে বলেই দাবি সে দেশের হিন্দু সমাজের।
Discussion about this post